রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


পশু কুরবানি আত্মকুরবানির প্রতীক


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০১৯ ১২:৩৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৪

প্রতিকি ছবি

পিতা-পুত্রের সুমহান আত্মত্যাগের ফলে প্রতিষ্ঠিত হলো ইব্রাহিম (আ)-এর সুন্নাত হিসেবে মানবসন্তানকে যবেহ করার পরিবর্তে সম্পদের মোহ ত্যাগ করে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার বিধান কুরবানি প্রথা। এর দ্বারা আল্লাহর প্রতি বান্দার প্রেম ও সম্পদের প্রতি লোভ-লালসার আতিশয্যের কামনা-বাসনা ত্যাগের পরীক্ষা করা হয়। এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে মুমিন বান্দারা পুণ্যের আধিক্যতা ও জান্নাতের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। এই ত্যাগের প্রতীক বা স্মারক হিসেবে কুরবানির ঈদের রীতি প্রবর্তিত হয়- যাতে সুস্পষ্ট হয়ে যায় ঈদুল আজহার সৌন্দর্য এবং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মানবিক মূল্যবোধ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো।’-কাওছার:২

সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহকে (স) জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই কুরবানি কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের সুন্নাত’। -ইবনে মাজা। মেহেরবান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য বছরে দুটি শ্রেষ্ঠ খুশির দিন উপহার দিয়েছেন। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা। দুই ঈদেরই রয়েছে দুই রকম বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ আসে ত্যাগের মহিমা নিয়ে। আরবি ‘আজহা’ এবং ‘কুরবান’ উভয় শব্দের অর্থ- উৎসর্গ। ‘কুরব্’ ধাতু থেকে কুরবানি শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ আত্মত্যাগ, উৎসর্গ বা বিসর্জন, নৈকট্য বা অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি। ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ বিশ্ব মুসলিম মননে আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের দৃঢ়প্রত্যয় গ্রহণের তাগিদ সঞ্চারিত করে।

ইসলামের পরিভাষায় কুরবানি বলা হয় ঐ নির্দিষ্ট পশুকে যা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর নামে জবাই করা হয়। কুরবানি দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় বলে এমন নামকরণ। কুরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। উদ্দেশ্য একটাই- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ -হজ্জ : ৩৪।

কুরবানির শুরু হয়েছিল আদম (আ)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মধ্যে সংঘটিত কুরবানির মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হ’ল এবং অন্যজনের কুরবানি কবুল হ’ল না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা কর আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ -মায়েদা : আয়াত ২৭-২৮। এ হলো কুরবানি কবুল হওয়া ব্যক্তির ভাবাবেগ ও মানসিকতা। কেননা কুরবানি তাকওয়াবান লোকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন।

বর্তমান মুসলিম মিল্লাতের এই কুরবান বা উৎসর্গের রয়েছে অর্থবহ এক ঐতিহাসিক পটভূমি। ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় ইসমাইল (আ)কে কুরবানির স্মৃতিময় ঘটনা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান করা। ইব্রাহিম (আ) স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কুরবানি দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন। এজন্য তিনদিনে দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কুরবানি করলেন; কিন্তু তা আল্লাহর দরবারে কবুল হলো না। বারবারই স্বপ্নে আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানি করো।’ ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিম (আ) উত্তীর্ণ হন।

ইব্রাহিম (আ.) ইসমাঈলকে স্বপ্নের কথা অবগত করে তার থেকে জবেহের পরামর্শ চাইলেন। বললেন অতএব তুুমি ভেবে দেখ তোমার অভিমত কি? এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতাআলা ঘোষণা করেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি? সে (হজরত ইসমাইল (আ) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ -সাফফাত : ১০২।

প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ) বললেন, আব্বাজান! ইহ জগৎ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আপনি আমার এই প্রার্থনাগুলো মনজুর করুন। ১. আপনি ছুরি খুব ধারালো করে নিন। আর আমার হাত পা শক্ত করে বেঁধে ফেলুন। যেন আমার অনিচ্ছাকৃত লাফা-লাফিতে আমার রক্তের ছিটা আপনার কাপড়কে নাপাক না করে। ২. আমাকে মাটির দিকে মুখ করিয়ে শোয়ায়ে দিন, যেন জবেহ করার সময় আমার চেহারা আপনি না দেখেন, যা জবেহ থেকে বাধা দিবে। ৩. আমার রক্ত মিশ্রিত জামা-কাপড় নিয়ে আম্মাজানকে দিবেন। তাহলে আমার আম্মা পুত্রের বিচ্ছেদের যন্ত্রনা লাঘব করতে পারবেন। এক রেওয়ায়েতে আছে যে, ইসমাঈল (আ) জবেহ করার খবর তার আম্মাকে না দিতে বলেছিলেন।

পরম সত্যের প্রবল আকর্ষণে ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর নির্দেশিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ)কে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। মুহূর্তে আশ্চর্যজনকভাবে আল্লাহর নির্দেশে ইসমাঈল (আ) সম্পূর্ণ নিরাপদে সংরক্ষিত হলেন এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম কুদরতে তদস্থলে পুত্রের বিনিময়ে বেহেশত থেকে আনীত কুরবানিকৃত দুম্বা উৎসর্গীত হলো।

এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘যখন তারা (পিতা-পুত্র) উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে (যবেহ করার জন্য) কাত করে শায়িত করলো, তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে!’ এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে (ইসমাঈল) মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানির বিনিময়ে।’ -সাফফাত : ১০৩-১০৭।

আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা হালাল পশু কুরবানি করবেন, তাদের পুণ্যের আধিক্য সম্পর্কে নবী করিম (স) বলেছেন, ‘আদম সন্তান কুরবানির দিন যেসব নেকির কাজ করে থাকে তন্মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হলো কুরবানি করা। কিয়ামতের দিন কুরবানির পশু তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কুরবানির রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা এ পুরস্কারে আন্তরিকভাবে খুশি হও।’ -তিরমিযি, ইবনে মাজা ও মিশকাত।

কুরবানির পর গোস্তের একটা অংশ চলে যায় আপনজনের মধ্যে যারা কুরবানি দিতে পারেননি তাদের ও গরিবের ঘরে। তার মানে কুরবানি ঈদে প্রত্যেকের ঘরে ঘরেই পৌঁছে যায় গোস্তের ভাগ। কুরবানির ঈদের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো সবার ঘরে গোস্ত পৌঁছে দেওয়ার এই সাম্যের ধারণ। এর চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে? অনেক মানুষ আছেন, যারা বছরের মধ্যে কুরবানি উপলক্ষেই পরিতৃপ্তিসহকারে একটু গোস্ত খেতে পারেন। এই সবার ঘরে ঘরে আনন্দ পৌঁছে দেওয়াটাই কুরবানির ঈদের মূল চেতনা। ত্যাগেও যে পাওয়ার আনন্দ আছে, ঈদুল আজহা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেটাই।

কুরবানির দ্বারা মুসলমানেরা ঘোষণা করে, তাদের কাছে আপন জানমাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল্য অনেক বেশি। সুতরাং কেউ যেন ঈদুল আজহার ত্যাগের মহান আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত না হয়। আল্লাহর কাছে কুরবানিকৃত পশুর রক্ত, গোস্ত, হাড় ইত্যাদি পৌঁছায় না, পৌঁছায় কেবল কুরবানিদাতার আন্তরিকতা, বিশুদ্ধ নিয়ত ও আল্লাহভীতি। এরদ্বারা আল্লাহ মানুষের অন্তরকে যাচাই করেন। কুরবানির মহান শিক্ষা হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা ও অন্তরের পবিত্রতা লাভ এবং সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ ও মনোমালিন্য থেকে মুক্ত থাকা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।’ -হজ্জ : ৩৭।

‘ত্যাগ’ ছাড়া ঈদুল আজহার আরেকটি বড় শিক্ষা হল আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। কুরবানির গোশত গরিব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী, মিসকিন, দ্বীন-দুঃখী, হতদরিদ্রসহ যত বেশি অভাবী মানুষকে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া যায় ততই উত্তম। এটা তাদের হক বা অধিকার। কুরবানি করে সব ফ্রিজে জমা রেখে সপরিবারে গোশত খাওয়া যেন ধনীদের মনকে পেয়ে না বসে। মানুষের মনের মধ্যে যে পশুশক্তি সুপ্ত বা জাগ্রত অবস্থায় বিরাজমান তা অবশ্যই কুরবান করতে হবে। কেননা কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা, পশু কুরবানি হচ্ছে আত্মকুরবানির প্রতীক মাত্র।

কুরবানির দিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধনী-গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে নামাজ আদায়, কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর কুরবানি করা হয়। এদিনে অশ্রুসিক্ত হয়ে অনেকেই যান কবরস্থানে, বাবা-মাসহ প্রিয়জনদের রুহের মাগফিরাত কামনায়।

পশু কুরবানির মাধ্যমে আমাদের মাঝে বিরাজমান যাবতীয় পশুত্ব তথা মির্মমতা, ক্রোধ, হানাহানি, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, সকল অশুভ ইচ্ছে ও কু-বাসনার কুরবানি হোক, সকল কু-রিপুর কুরবানি হোক। মানবতাবোধে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষাই হলো কুরবানির মহান শিক্ষা। সত্য সুন্দর আর পবিত্রতায় সকল কু-রিপুকে কুরবানি করে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক এই কামনা মহান করুনাময় মেহেরবান আল্লাহর পাকের দরবারে। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানোর জন্য কুরবানি নয় বরং পশুকে জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করুন। কুরবানির মাধ্যমে নিজেকে তাকওয়াবান হিসেবে তৈরি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top