শীঘ্রই স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিদের নিষিদ্ধ করার আইন

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ রহিত করে ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২০’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃংখলার মধ্যে আনতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আইনটির একটা খসড়া তৈরি করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। খবর বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর।
তাতে বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যাঁরা স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হবেন তাঁরা রাজনৈতিক কোনো পদ পাবেন না। এমনকি বিদেশ ভ্রমণ কিংবা গাড়ি-বাড়ি রেজিস্ট্রেশনও করতে পারবেন না। ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু থেকে শুরু করে কোম্পানি নিবন্ধনও করতে পারবেন না। এসব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে সরকার।
স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের প্রতি এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নতুন ফাইন্যান্স কম্পানি আইনের ৫১ পৃষ্ঠার খসড়াটি রোববার সবার মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এরপর তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পরবর্তী ধাপে তা অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে।
আইনের খসড়ায় স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতা ও স্বেচ্ছা খেলাপিদের ব্যাপারে ধারা ৩০-এ বলা হয়েছে, স্বেচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতারা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কোনো ধরনের পেশাজীবী, ব্যাবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির পদেও থাকতে পারবেন না তাঁরা।
একই ধারার উপধারা ৫-এ স্বেচ্ছা খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে বাধার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বেচ্ছা খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের তালিকা সরকারের কাছে পাঠাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুরোধ করলে সরকার এসব ঋণখেলাপির বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। গাড়ি ও বাড়ি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, ‘যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর’ এর কম্পানি নিবন্ধনের বিষয়েও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে।
আর উপধারা ৩ মোতাবেক খেলাপি ঋণগ্রহীতারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের ঋণ পাবেন না। উপধারা ২ মোতাবেক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া আদালতে আবেদন করবে।
ঋণখেলাপিরা এক মাসের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে উপধারা ৪ মোতাবেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে সংশ্লিষ্ট খেলাপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারবে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে খসড়া আইনের ধারা ২৬-এর উপধারা ১-এ বলা হয়েছে, প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে পরিশোধিত মূলধন ও রিজার্ভের মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশের বেশি সামষ্টিকভাবে বিনিয়োগ করতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত মূলধন ও রিজার্ভের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে।
উপধারা ২-এ বলা হয়েছে, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবসিডিয়ারি ছাড়া অন্য কোনো কম্পানিতে পরিশোধিত মূলধন ও রিজার্ভের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার অর্জন বা ধারণ করতে পারবে না।
খসড়া আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের ব্যাপারে বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তিনজন স্বতন্ত্রসহ ১৫ জনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্তৃত্ব ক্ষুন্ন করা যাবে না।
এক প্রতিষ্ঠানে একই পরিবারের দুজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। তার পরও শর্ত থাকে যে, তাঁদের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারের অধিকারী হতে হবে। আর ন্যূনতম দুই কিন্তু অনধিক ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার না থাকলে ওই পরিবারের একজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না।
বিদেশি শেয়ারহোল্ডারের ক্ষেত্রে পরিচালকসংখ্যা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দেবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিচালক একই সময়ে অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক কম্পানির পরিচালক থাকতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত হতে পারবেন না।
কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি বিধিতে দণ্ডিত হলে কিংবা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যবিধ অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এমন কেউ ফাইন্যান্স কম্পানির প্রধান নির্বাহী নিযুক্ত হতে পারবেন না। তিনি নিজে বা তাঁর সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে কিংবা আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হলে তিনি প্রধান নির্বাহী হতে পারবেন না।
একজন পরিচালকের মেয়াদ হবে তিন বছর। একাধারে পর পর তিন মেয়াদে অর্থাৎ টানা ৯ বছর পরিচালক হিসেবে থাকতে পারবেন। এরপর আরও তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর একই ব্যক্তি পুনরায় পরিচালক পদে মনোনীত হতে পারবেন। এ ছাড়া খসড়া আইনটিতে বিভিন্ন অন্যায়ের ক্ষেত্রে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
খসড়া আইনে স্বেচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাক্তি তার নিজের বা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত ঋণ বা তার অংশ বা তার উপর অর্জিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিশোধ না করেন।
যদি কোনো ব্যাক্তি জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ গ্রহণ করেন। বা কাউকে যে উদ্দেশ্যে ঋণ প্রদান করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে উক্ত ঋণ বা ঋণের অংশ ব্যবহার বা স্থানান্তর করেন; বা যদি কোনো ব্যক্তি ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ প্রদানকারী ফাইন্যান্স কোম্পানির অজ্ঞাতসারে হস্তান্তর বা স্থানান্তর করেন তবে তিনি স্বেচ্ছা বা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন।
বর্তমানে দেশে ব্যাংক বহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। অবসায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস। এছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ। কয়েকটি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
আরপি/এমএইচ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: