রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


কিভাবে বাঁচবো বলো?


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০১৯ ১২:২৩

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৪২

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম:

মজিদ কয়েকটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু সজল চোখে কেঁদেই চলেছে। গত রাতে দৃর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় তার স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে সহ পরিবারের পাঁচ সদস্য। এগুলো তাদেরই কবর। ঘটনার সময় মজিদ উকিলের বাড়ীতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। এখন তাদের স্মৃতি মনে বেদনা জাগিয়ে তাড়া করায় সে নিজেকে সামলাতে না পেরে আবেগ তাড়িত হয়ে কবরের সামনে হু হু করে কাঁদছে।


মজিদ একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী। বাজারে রয়েছে একটি ছোট মুদীর দোকান। স্ত্রী এক ছেলে এবং দু’মেয়ে নিয়ে তার সুুখের সংসার। ব্যবসা করে যা উপার্জন করে তা দিয়েই দিনগুলি তাদের ভালই কাটছিলো। বড় মেয়ে শম্পার বয়স চৌদ্দ বছর। সে স্থানীয় গার্লস স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ছেলেটির বার বছর, এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। ছোট মেয়েটির এক বছর। সে কেবল হাটি হাটি পা করছে।

ভিটে বাড়ী ছাড়াও মজিদের রয়েছে এক বিঘা ধানী জমি। সুশীল নামে এক হিন্দু ভারত চলে যাবার সময় পাঁচ বছর আগে তার কাছে ঐ জমি বিক্রি করে। এত দিন ভোগ দখল করলেও গত মাসে চাষ করতে গেলে ফয়সাল নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তার দাবী করে জমিতে যেতে বাঁধা দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং জীবন নাশের হুমকি দেয়। এ বিষয়ে মজিদ স্থানীয় থানায় অভিযোগ করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ তার অভিযোগ গ্রহণ না করে জমিটি ফয়সালকে ছেড়ে দিতে বলেন। নচেৎ ভাল হবে না বলে জানান।

মজিদ বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ইউ.পি চেয়ারম্যান সহ অনেক জায়গায় অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পায় না। বরং দিন দিন ফয়সালের সাথে তার শত্রুতা বেড়েই চলে। প্রায় প্রতিদিন ফয়সাল এবং তার লোকজন দোকানে এসে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। মজিদ কোথাও কোন কিছু করতে না পেরে অবশেষে ফয়সালের বিরুদ্ধে আদালতের স্মরনাপন্ন হয়। এতে ফয়সাল ও তার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য মজিদের উপর প্রচণ্ডভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। মজিদও না ছোড় বান্দা, জীবন যায় যাক তবুও সে ফয়সালের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিবে না। বাধ্য হয়ে ফয়সালের লোকজন মজিদকে মেরে ফেলার জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র করে।

মজিদ এবারও থানায় গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে আসে। ভাবে কোথায় যাবে সে, গরীব বলে কোথাও তার জায়গা নেই। সেদিন দুপুরে পরিবার পরিজন সহ খাবার সময় ফয়সাল দলবল নিয়ে তার বাসায় এসে স্ত্রী ছেলে মেয়েদের সামনে তাকে অশ্রাব্য এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আগামী এক মাসের মধ্যে মামলা তুলে জায়গা ছেড়ে না দিলে পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দিয়ে দলবল সহ চলে যায়। ছেলে মেয়েরা এতে ভয় পেয়ে মজিদকে আঁকড়ে ধরে।

পুড়ে মারার হুমকি দেওয়ায় ফয়সালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য মজিদ না খেয়েই পুনরায় থানায় যায়। ফয়সালের মতো একজন সম্মানী ব্যক্তি এ ধরণের কাজ করতেই পারে না বলে তারা জানায়। উপরন্তু ফয়সালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় থানার লোকজন তাকে অপমান করে থানা থেকে তাড়িয়ে দেয়। এবারেও সে বিফল মনোরথে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

মজিদ বাসায় ফিরে দেখে স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার অপেক্ষার বসে আছে। সবাইকে অভয় দিয়ে বলে, থানা বলেছে বিষয়টি তারা দেখবে। কোন ভয় নেই। তার কথায় ছেলে-মেয়েরা আশ্বস্ত হলেও স্ত্রী চিন্তিত হয়। কারণ তার স্বামীর চেহারার মধ্যে আতংকের সুস্পষ্ট ছাপ। মজিদকে খেতে বললেও সে খায়না।

পরের দিন মজিদ দোকানে বসে এক গ্রাহকের কাছে সওদা বিক্রির সময় থানা থেকে একজন পুলিশ এসে সমন দিয়ে জানায় আগামীকাল কোর্টে তার মামলার তারিখ আছে সে যেন সময়মতো হাজির হয়। সমন হাতে নিয়ে পড়তেই ফয়সাল এবং তার দলীয় লোকজন সহ এসে তার হাত থেকে সমন কেড়ে নিয়ে ছিড়ে ফেলে এই বলে শাসায়, যদি আগামীকাল কোর্টে হাজির হোস তবে এ দেখাই শেষ দেখা হবে। বউ, ছেলে, মেয়ে নিয়ে আর সংসার করতে হবে না। শুনে মজিদ প্রতিবাদ করে বলে, দেশটি কি শুধু আপনার? আর এটা কি মগের মুল্লুক। যা ইচ্ছে তাই করবেন। আমি অবশ্যই যাবো। আপনার যা খুশী করেন। আমি আপনাকে পরোয়া করি না। মজিদের কথায় ফয়সাল অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলে, ঠিক আছে গিয়ে দেখ। তারপর পরিবারসহ তোর ব্যবস্থা হবে। পরে আফসোস করে কুলাতে পারবি না। এ কথা বলেই ফয়সাল লোকজন সহ চলে যায়।

মজিদ অনেকক্ষণ মন খারাপ করে বসে থেকে বাসায় গিয়ে স্ত্রী, ছেলে, মেয়েদের কাছে বিস্তারিতভাবে ঘটনা জানিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। ছেলে মেয়েরা তাকে বলে, বাবা তুমি কোর্টে যেও না। মামলা তুলে নিয়ে লোকটিকে জমি দিয়ে দাও। না হলে আমাদের কাউকে বাঁচতে দিবে না। মজিদ স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। চোখে তার চরম নৈরাশ্য এবং সীমাহীন হতাশা।

পরের দিন সকালে মজিদ আদালতে যায়। ফয়সালরাও আদালতে হাজির হয়। আদালত ফয়সালের জামিন না মঞ্জুর করে তাকে জেলে পাঠায়। কোর্ট হাজত থেকেই সে মজিদকে বলে, যেদিন জামিনে বের হয়ে আসবো যেদিনই তুই সহ তোর পরিবারের লোকদের এই পৃথিবীতে শেষ দিন হবে। মজিদ মন খারাপ করে চিন্তিত মনে বাসায় ফিরে। এক অজানা আশংকায় তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠে। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে স্ত্রী মাজেদা পাশে বসিয়ে সান্তনা দেয়। বাবার এই অবস্থা দেখে ছেলে মেয়েরা ভয় পেয়ে বাবাকে জড়িতে ধরে।

এক সপ্তাহ পর মজিদ সন্ধ্যায় দোকানে বেচা বিক্রি করার সময়ই জানতে পারে যে, ফয়সাল আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে। শুনে অজানা আশংকায় মজিদের মন খারাপ হয়ে যায়। বেচা বিক্রি না করে সে দোকান বন্ধ করতে থাকে। এ সময় পাশের দোকানদার বলে , কি গো মজিদ ভাই, শরীর খারাপ নাকি? মজিদ তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাসায় চলে যায়।

বিমর্ষ চেহারা দেখে স্ত্রী মাজেদা কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে মজিদ বলে, তারা মনে হয় আমাদেরকে বাঁচতে দিবে না। মজিদের এ কথায় স্ত্রী সহ ছেলে মেয়েরা আতংকিত হয়ে উঠে। বড় মেয়ে বাবার জন্য ভাত বেড়ে খেতে ডাকে। তার খেতে ইচ্ছে করে না। মেয়ের তাগাদায় কোন রকমে সামান্য খেয়ে জামিন পেয়ে ফয়সালের গ্রামে ফিরে আসার কথা জানায়। মজিদ উদ্বেগ সহকারে আরও জানায়, যখন তখন সে তাদের চরম ক্ষতি করতে পারে। তাই এখনই সে উকিলের বাসায় গিয়ে এ ব্যাপারে আলাপ করে থানা হয়ে বাসায় ফিরবে। রাতে একা যাবার জন্য সবাই তাকে নিষেধ করে। বড় ছেলে বাবার সঙ্গে যেতে চায়। কিন্তু মজিদ তাকে না নিয়ে একাই রওয়ানা হয়। রাতে স্ত্রীকে ঘরের দরজা ভালমতো লাগিয়ে ঘুমুতে বলে। যাবার সময় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা মজিদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। তখন কি তারা ভাবতে পেরেছিলো এ দেখাই শেষ দেখা।
রাত ১১ টার সময় উকিলের বাসায় বসে শুনতে পায় দুর্বত্তরা তার ঘরে তালা লাগিয়ে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করায় তার স্ত্রী, ছেলে এবং দু’মেয়ে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। শুনে মজিদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আহাজারি করতে করতে দৌড়ে বাসায় এসে দেখে তার পরিবারের সবাই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এই মর্মান্তিক, হৃদয় বিদারক এবং করুন দৃশ্য দেখে মজিদ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে সে নির্বাক হয়ে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এ সময় তার দুচোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে থাকে।

পরের দিন সকালে সবাইকে গ্রামের কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়। সবাই চলে গেলেও তিনি কখনো স্ত্রী, কখনো ছেলে আবার কখনো দু’মেয়ের কবরের কাছে গিয়ে কবর নেড়ে চোখের পানি ফেলে আহাজারি করতে করতে বলেন, তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদেরকে বাঁচাতে পারি নাই। তোমাদের ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো বলো?
বাসায় ফিরে ভস্মিভূত শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে মজিদ জোরে হু হু করে কেঁদে উঠে। এখানে স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সহ জীবনের অনেকদিন কাটিয়েছে। গত রাতেও তারা ঐ ঘরে ছিল। আজ আর নেই। বড় ছেলেটি তার সাথে যাবার জন্য বারবার বলেছিল, কিন্তু সে নেয়নি। নিলে সে বেঁচে যেত। কিন্তু এখন যে আর কেউ রইলো না। এসব চিন্তা করতে করতে মজিদ একসময় অসুস্থ হয়ে রান্না ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়ে। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও তার কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় পাশের বাড়ীর লোকজন এসে দেখেন মজিদ স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের শোক সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু বরণ করেছে। মরে গিয়ে মজিদ অনাবিল শান্তি পেয়েছে যা ফয়সালের মতো লোকেরা তাকে কোন দিন পেতে দেয়নি। তাকে স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হয়। মজিদ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সহ কবরে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে যা বেঁচে থাকতে কখনো পায় নি।

লেখক: সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তা


বিষয়: সাহিত্য


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top