রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


রাতারাতি বস্তা বদল, ওএমএস’র চাল লুটপাট


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০২০ ১১:৫৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:০০

ছবি: সংগৃহীত

কথায় আছে, বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে ফেলেছে। ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচির চাল ও আটা বিক্রির ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে। যারা মনিটরিং করার দায়িত্বে, তাদের যোগসাজশেই বস্তা বদল করে রাতারাতি সরকারি কম মূল্যে বিক্রির এই খাদ্যপণ্য চলে যাচ্ছে আড়তদারের ঘরে। মাঝখানে সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ঢুকছে লাখ লাখ টাকার কমিশন। এভাবে গরিবের চাল, আটা লুটপাটের ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে খোদ রাজধানীতে। খাদ্য অধিদফতরের আওতায় ১২০টি পয়েন্টে প্রতিদিন অবাধে এই দুর্নীতি-লুটপাট চলছে। যুগান্তরের সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে যার আদ্যোপান্ত বেরিয়ে এসেছে।

সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলছেন, এভাবে ওএমএস-এর চাল চোরাই পথে বাজারে চলে আসার কারণে সরকার বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে চোরাকারবারিদের হাত ঘুরে আসা খোলাবাজারের চাল সাধারণ মানুষকে উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। সঙ্গত কারণে ওএমএস কর্মসূচি কার্যত কাজে আসছে না।

লুটপাট হয় যেভাবে : ৩০ সেপ্টেম্বর বেল ১১টা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সরেজমিন যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম রাজধানীর কচুক্ষেত বাজার সংলগ্ন রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট হাজির। সি-১১২ নম্বর রিফাত এন্টারপ্রাইজ নামের দোকানটি ওএমএস সেলস পয়েন্ট হিসেবে নির্ধারিত। সকাল ৮টার পর থেকেই চাল ও আটাবোঝাই ট্রাক একের পর এক থামছে দোকানের সামনে। গোডাউন প্রায় ভর্তি। কিন্তু সারা দিনে ক্রেতার দেখা নেই। নিয়মানুযায়ী সম্পূর্ণ চাল ও আটা বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত নতুন ট্রাক আসার কথা নয়। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। প্রায় প্রতিদিনই সরকারি গুদাম থেকে ট্রাকভর্তি চাল আসছে। বাস্তবে এক কেজি চাল বিক্রি না হলেও খাতা-কলমে দেখানো হচ্ছে ‘পুরোটাই বিক্রি’।

বেলা তখন সোয়া ১টা। কাফরুল থানার বিপরীতে গোয়ালবাড়ি এলাকা। চিপা গলির মধ্যে খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ঢাকা মেট্রো ড-১১-০৬৪১ নম্বরের ট্রাক। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ট্রাকটি ঘিরে বেশ কয়েকজন লোক পাহারায়। তারা এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলির একটি বন্ধ দোকানের শার্টার খোলেন। কিছুক্ষণ পর ট্রাক থেকে ত্রিপল সরানো হয়। ট্রাকভর্তি প্রতিটি বস্তায় সরকারি সিল মারা। ঝড়ের গতিতে বস্তা নামিয়ে রাখছেন তিনজন শ্রমিক। স্বল্পসময়ের মধ্যেই বস্তা আনলোড করে খালি ট্রাক চলে গেল অন্যত্র। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে ঘটনার পুরো ভিডিওচিত্র গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে যুগান্তর অনুসন্ধান টিম।

এরপর বেলা ২টা। কচুক্ষেত হয়ে মিরপুর ১০ নম্বর এবং ভাষানটেকের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে চোরাকারবারিদের আরও কয়েকটি ট্রাকের সন্ধান মেলে। ঢাকা মেট্রো ট-১৫-৪২৬২ নম্বর ট্রাকটি দাঁড়িয়ে সেনপাড়া পর্বতা এলাকার মিশন মোড়ে। চালকের নাম এনামুল। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কাছে গিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চালকের সোজাসাপ্টা উত্তর- ‘ট্রাকে আটা লোড হবে। আটা ভর্তি করে ট্রাক নিয়ে যাবেন ভালুকায়।’ ভাড়া কত জানতে চাইলে চালক বলেন, ‘ভাই, এসব আটাতে ঝামেলা আছে। তাই আমরা ভাড়া একটু বেশি নিই।’ বোঝা গেল সরকারি আটার বস্তা পাচার করা হচ্ছে এই ট্রাকে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিনের বেলা বিভিন্ন রেশনিং পয়েন্ট থেকে ছোট ও মাঝারি ধরনের ট্রাকে করে ওএমএস চাল ও আটা আনা হয় নির্ধারিত কিছু গোডাউনে। সেখানে দ্রুত বস্তা বদলের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার পর এসব খাদ্যপণ্য দেশের বিভিন্ন রুটে বড় ট্রাকে বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে একটি চৌকস ও বিশ্বস্ত টিম পুরো প্রক্রিয়া সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে। যারা দালাল হিসেবে চিহ্নিত। এরাই মূলত রেশনিং পয়েন্ট থেকে খাদ্যপণ্য আনার আগে খাদ্য কর্মকর্তাদের কাছে নগদ অর্থ নিয়ে ধরনা দিয়ে থাকে। ওএমএস চাল ও আটা কেনা নিয়ে এদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপও তৈরি হয়েছে।

এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর যুগান্তর অনুসন্ধান টিম রাত ১২টায় উপস্থিত হয় কাফরুল থানা ভবনের বিপরীত পাশে। ট্রাক নম্বরসহ সোর্সের দেয়া তথ্য হুবহু মিলে যায়। দেখা গেল, ওএমএস বস্তা বদলানো চাল ঢাকার বাইরে পাঠানোর জন্য লোড করা হচ্ছে। এসব ট্রাক কোথায় যাবে জানতে চাইলে উপস্থিত লোকজন উল্টো ধমকের সুরে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। আমরা সাংবাদিক কি না, তা-ও জানতে চাইলেন। আবার দেখা গেল ৩-৪টি ট্রাকের নম্বর প্লেট কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে তাদের সন্দেহ যেমন বাড়ল, তেমনই যুগান্তর অনুসন্ধান টিমও ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে যায়। একজন ট্রাকচালক তো অকপটে বলেই ফেললেন, ‘ভাই এসব চাল নিয়ে ঝামেলা আছে। এখান থেকে চইলা যান। ঝামেলা কইরেন না।’ এ সময় কয়েকটি ট্রাকের নম্বর উদ্ধার করতে সক্ষম হয় যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম। এগুলো হল- ঢাকা মেট্রো ন-১১-২০৩৩, ঢাকা মেট্রো ন-১১-১১১১, ঢাকা মেট্রো ড-১৩-৭১১৪ এবং কুড়িগ্রাম মেট্রো ন-১১-০০১১।
অভিযোগ আছে, সরকারি খাদ্যপণ্যের চোরাকারবারিদের সবার নাম-ঠিকানা পুলিশের জানা। কিন্তু মাসোহারায় চুপ থাকার কৌশল নিয়েছে থানা পুলিশ।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে চাল চুরি সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে যাদের নাম জানা যায়, তারা হলেন রিফাত এন্টারপ্রাইজ ও রহমান ট্রেডার্সের মালিক আবু মুসা খান, তার সহযোগী আবু সাঈদ ওরফে ভাগনে সাঈদ ও মাহমুদ, আতিক হাজী, ডি-১ রেশনিং এলাকার সঙ্গে যুক্ত ডিলার নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ওরফে মিজান (র‌্যাবের মামলার আসামি), ডি-৫ এর চাল চোরাকারবারি মনির, ডি-৯ এর সঙ্গে যুক্ত মোজাম্মেল, আরিফ, ডি-৩ এলাকার শাহজাহান। ডি-৬ এর প্রায় সব চাল ও আটা কিনে নেয় চোরাকারবারি মিলন। ডি-৪ এর ডিলার হিসেবে পরিচিত জুয়েল অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার সঙ্গে নাকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের ওঠাবসা। এছাড়া সালমান ও আরিফ নামের দুই চোরাকারবারির কাজই হল অসাধু ডিলারদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ওএমএস পয়েন্টের চোরাই চাল কিনে আনা।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, খাদ্য অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সরকারি খাদ্যপণ্যের চোরাকারবারে জড়িত। সংশ্লিষ্ট রেশনিং এলাকার এআরও (সহকারী রেশনিং কর্মকর্তা), তদারক এবং গুদাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে। চোরচক্রের সদস্যরা প্রশ্রয় পাচ্ছে ঢাকা রেশনিংয়ের এক কর্তাব্যক্তির কাছে। বিতর্কিত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে লোভনীয় পোস্টিং বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচারের লিখিত অভিযোগ সম্প্রতি জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও।

যা বললেন মহাপরিচালক : ওএমএস’র চাল চুরির সরেজমিন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ৪ অক্টোবর সকালে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের মুখোমুখি হয় যুগান্তর প্রতিবেদক। মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সারোয়ার মাহমুদ সবকিছু শুনে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, ‘কাউকে ছাড়া হবে না। প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি ঘুষ খাই না, খেতেও দেব না। এদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’ যুগান্তর প্রতিবেদকের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার পর তিনি অধিদফতরের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাকে তার দফতরে তাৎক্ষণিক ডেকে পাঠান। তারা আসার পর মহাপরিচালক তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘অধিদফতরে বসে মনিটরিং করলে হবে না। সত্যিকারের মনিটরিং করতে হলে মাঠে যান। সাংবাদিকরা চুরির তথ্য পেলে আপনারা পান না কেন? আপনাদেরও জবাব দিতে হবে।’ তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের এক্ষুনি কারণ দর্শনোর নোটিশ দেন। দুর্নীতির সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।’

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাল ও আটা বিক্রির সেলস পয়েন্টগুলো নির্ধারণ করার সময়ই দুর্নীতির ফাঁক রাখা হয়। এমন সব জায়গায় সেলস পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে, যা সাধারণের দৃষ্টিসীমার বাইরে। গলিপথের শেষ প্রান্তে অন্ধকারের মধ্যে কোনো কোনো সেলস পয়েন্ট। ফলে ক্রেতারা ওএমএস-এর মাধ্যমে চাল বিক্রির বিষয়টি জানতেও পারেন না। ডিলারদের অবাধ চুরির সুযোগ করে দেয়ার বিনিময়ে দৈনিকভিত্তিক ঘুষ নেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এসব কারণে খাদ্য পরিদর্শকদের প্রাইজপোস্টিং নিয়ে বড় ধরনের বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে প্রবল। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পেতে অর্ধকোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে হয়। উভয়পক্ষ সুবিধাভোগী হওয়ায় এসব দুর্নীতির কোনো প্রমাণ থাকে না।

 সুত্র: যুগান্তর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top