রাজশাহী মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২রা আশ্বিন ১৪৩১


রাস্তার একটি দিক নির্দেশক তৈরিতে খরচ ২৫ লাখ!


প্রকাশিত:
২ নভেম্বর ২০১৯ ১৯:৩৫

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০০:৫০

ছবি: সংগৃহীত

কোনো একটি মহাসড়কে একটি ‘ওভারহেড ডিরেকশনাল সাইন’ (সড়কের ওপরে দিকনির্দেশক চিহ্ন) নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ২৫ লাখ, আরেকটি মহাসড়কে কাছাকাছি ধরনের একটি ‘ওভারহেড গ্যানট্রি সাইন’ নির্মাণে খরচ হচ্ছে ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকা! সাইন দুটি কাছাকাছি ধরনের হলেও খরচের পার্থক্য প্রায় ১৮ লাখ টাকা!

এক মহাসড়কে একটি ‘ডিরেকশনাল সাইন’ নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে সাড়ে ২৫ হাজার টাকা, অন্য মহাসড়কে একই সাইন নির্মাণে প্রতিটিতে খরচ করা হচ্ছে এক লাখ টাকা! আরেক মহাসড়কে তা দুই লাখ!

আবার এক মহাসড়কে একটি ট্রাফিক সাইন নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে পাঁচ হাজার, অন্য মহাসড়কে একটি ট্রাফিক সাইন নির্মাণেই খরচ করা হচ্ছে ৬৫ হাজার টাকা!

বর্তমান সরকার গঠনের পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বিভিন্ন সময় অনুমোদিত সাতটি প্রকল্প বিশ্লেষণ করে এ অসঙ্গতির তথ্য পাওয়া যায়। সবগুলো প্রকল্পই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) বাস্তবায়ন করছে।

নির্মাণাধীন এ সাত মহাসড়কের দিক-নির্দেশক স্থাপনে দামের অসঙ্গতির বিষয়গুলো তুলে ধরতে গেলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, ‘আপনার কথা বিস্তারিত শোনার মতো সময় আমার নাই। বুঝছেন? কারণ সেখানে আমাদের এক ডজন লোক আছে। তাদের সঙ্গে আপনি পরামর্শ করেন।’

একটি সাইন নির্মাণের জন্য ২৫ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে, এটা কতটা যৌক্তিক? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, ‘এটা আমার জানা নাই। বাজার দাম অনুযায়ী, সিডিউল অনুযায়ী দেখতে পারেন। আরে ভাই, আপনার এটা নিয়ে এত টেনশন কেন? আপনার তো এটা নিয়ে টেনশন থাকার কথা নয়।’

বিষয়গুলো অবহিত করা হয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে লিখিত দেন, আমি খোঁজ-খবর নেব। আমার কিছু নিয়ম আছে। সতর্কতার সঙ্গে নির্ভুলভাবে বিষয়গুলো লেখেন।’

প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেয়ার আগে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা যেন পণ্যের মূল্য ভালোভাবে যাচাই করেন, সেই নির্দেশনা একাধিকবার দেয়া হয়েছে। তারপরও কেন এমন অসঙ্গতি উঠে আসছে- জানতে চাইলে এম এ মান্নান বলেন, ‘আমি যে বারবার কথাগুলো বলি, এমন না যে রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে। তবে আমি আমার চাপ অব্যাহত রাখব।’

নির্বাচিত প্রকল্প সাতটি হলো- ‘নেত্রকোনা-কেন্দুয়া-আঠারবাড়ী-ঈশ্বরগঞ্জ জেলা মহাসড়ক উন্নয়ন’, ‘নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা (বাগড়া)-কুনিয়া-মেদনী-রাজুরবাজার সংযোগ মহাসড়ক নির্মাণ’, ‘ডোমার-চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ (জেড-৫৭০৬), ডোমার (বোড়াগাড়ী)-জলঢাকা (ভাদুরদরগাহ) (জেড-৫৭০৪) এবং জলঢাকা-ভাদুরদরগাহ-ডিমলা (জেড-৫৭০৩) জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’, ‘নীলফামারী-ডোমার (জেড-৫৭০৭) সড়ক ও বোদা-দেবীগঞ্জ (জেড-৫০০৩) সড়ক (নীলফামারী অংশ) এবং ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর (জেড-৫৮৫৭) সড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ’, ‘রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের অধীন পাহাড়/ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের বিভিন্ন কিলোমিটারে ড্রেনসহ স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক আরসিসি রিটেইনিং ওয়ার নির্মাণ’, ‘শরীয়তপুর (মনোহর বাজার)-ইব্রাহিমপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত সড়ক (আর-৮৬০) উন্নয়ন’ এবং ‘যাত্রাবাড়ী (মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার)-ডেমরা (সুলতানা কামাল সেতু) মহাসড়ক (আর-১১০) চারলেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্প।

মহাসড়কে এক দিক-নির্দেশক নির্মাণে ব্যয় ২৫ লাখ!

‘নেত্রকোনা-কেন্দুয়া-আঠারবাড়ী-ঈশ্বরগঞ্জ জেলা মহাসড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পে চারটি ‘ওভারহেড ডিরেকশনাল সাইন’ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ওভারহেড ডিরেকশনাল সাইন নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা!


আর ‘ডোমার-চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ (জেড-৫৭০৬), ডোমার (বোড়াগাড়ী)-জলঢাকা (ভাদুরদরগাহ) (জেড-৫৭০৪) এবং জলঢাকা-ভাদুরদরগাহ-ডিমলা (জেড-৫৭০৩) জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ ‘ওভারহেড গ্যানট্রি সাইন বোর্ড’ স্থাপন করা হবে ২৬টি। এজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক কোটি ৭৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ওভারহেড গ্যানট্রি সাইন স্থাপনে খরচ করা হচ্ছে ছয় লাখ ৮০ হাজার ৭৩০ টাকা।

একটি ওভারহেড ডিরেকশনাল সাইন নির্মাণে ২৫ লাখ খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা তো নির্ভর করে সাইজের ওপর। ব্যয় নির্ধারণ ঠিক আছে বলেই তো অনুমোদন হয়েছে। তারপরও বিষয়টা আবার দেখব।’

একটি ওভারহেড গ্যানট্রি সাইন নির্মাণে ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকার ওপরে খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ওভারহেড গ্যান্ট্রির জন্য আগে ফাউন্ডেশন দিতে হবে, তারপর ওপরে পাইপ দিতে হবে এবং রিফ্লেক্টিভ সাইন দিতে হবে। এটা অনুমোদন নিয়েই করা হচ্ছে। এজন্য যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ঠিক আছে।’

৫ হাজারের ট্রাফিক সাইন ৬৫ হাজারে নির্মাণ!

‘যাত্রাবাড়ী (মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার)-ডেমরা (সুলতানা কামাল সেতু) মহাসড়ক (আর-১১০) চারলেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পে প্রতিটি ট্রাফিক সাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে পাঁচ হাজার ৬৫৪ টাকা, ‘নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা (বাগড়া)-কুনিয়া-মেদনী-রাজুরবাজার সংযোগ মহাসড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পে পাঁচ হাজার ৬৬৭ টাকা, ‘নীলফামারী-ডোমার (জেড-৫৭০৭) সড়ক ও বোদা-দেবীগঞ্জ (জেড-৫০০৩) সড়ক (নীলফামারী অংশ) এবং ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর (জেড-৫৮৫৭) সড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পে পাঁচ হাজার ৬৫১ টাকা, ‘রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের অধীন পাহাড়/ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের বিভিন্ন কিলোমিটারে ড্রেনসহ স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক আরসিসি রিটেইনিং ওয়ার নির্মাণ’ প্রকল্পে পাঁচ হাজার ৯৩৩ টাকা এবং ‘শরীয়তপুর (মনোহর বাজার)-ইব্রাহিমপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত সড়ক (আর-৮৬০) উন্নয়ন’ প্রকল্পে পাঁচ হাজার ৬৫০ টাকা খরচ ধরা হয়েছে।

অথচ ‘নেত্রকোনা-কেন্দুয়া-আঠারবাড়ী-ঈশ্বরগঞ্জ জেলা মহাসড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পে ১০০টি ট্রাফিক সাইনের জন্য বরাদ্দ আছে ৬৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ট্রাফিক সাইন নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ৬৫ হাজার ৬৫০ টাকা!

অন্য মহাসড়কগুলোতে পাঁচ হাজার টাকায় ট্রাফিক সাইন নির্মাণ করা হলেও নেত্রকোনা-ঈশ্বরগঞ্জ মহাসড়কে ৬৫ হাজারের বেশি খরচ হচ্ছে কেন? জবাবে সওজের ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘ঠিক আছে, এ বিষয়গুলোও দেখব আমরা। পরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’

ডিরেকশনাল সাইন : কোথাও ২৫ হাজার, কোথাও খরচ ২ লাখ!

এবার মহাসড়কে ‘ডিরেকশনাল সাইনবোর্ড’ নির্মাণ প্রসঙ্গ। ‘ডোমার-চিলাহাটি-ভাউলাগঞ্জ (জেড-৫৭০৬), ডোমার (বোড়াগাড়ী)-জলঢাকা (ভাদুরদরগাহ) (জেড-৫৭০৪) এবং জলঢাকা-ভাদুরদরগাহ-ডিমলা (জেড-৫৭০৩) জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ প্রকল্পে ২৪টি ডিরেকশনাল সাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ছয় লাখ ১২ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি সাইন নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ২৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘নীলফামারী-ডোমার (জেড-৫৭০৭) সড়ক ও বোদা-দেবীগঞ্জ (জেড-৫০০৩) সড়ক (নীলফামারী অংশ) এবং ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর (জেড-৫৮৫৭) সড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পেও ২৫ হাজার ৫০০ টাকা করে ১০টি ডিরেকশনাল সাইন স্থাপন করা হচ্ছে।

ওই দুই মহাসড়কের প্রতিটি ডিরেকশনাল সাইন নির্মাণে সাড়ে ২৫ হাজার টাকা করে খরচ হলেও অন্যগুলোর কোনোটাতে এক লাখ, কোনোটাতে দুই লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি ‘রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের অধীন পাহাড়/ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের বিভিন্ন কিলোমিটারে ড্রেনসহ স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক আরসিসি রিটেইনিং ওয়ার নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে ১২টি ডিরেকশনাল সাইনবোর্ড স্থাপনে ব্যয় করা হচ্ছে ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটিতে খরচ হচ্ছে দুই লাখ টাকা। আরেকটি হলো ‘শরীয়তপুর (মনোহর বাজার)-ইব্রাহিমপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত সড়ক (আর-৮৬০) উন্নয়ন’ প্রকল্প। এতে ২০টি ডিরেকশনাল সাইনবোর্ড নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ প্রকল্পেও প্রতিটি ডিরেকশনাল সাইনবোর্ড নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে দুই লাখ টাকা।

‘যাত্রাবাড়ী (মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার)-ডেমরা (সুলতানা কামাল সেতু) মহাসড়ক (আর-১১০) চারলেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পে আটটি ডিরেকশনাল সাইন নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আট লাখ টাকা। অর্থাৎ এ মহাসড়কে প্রতিটি ডিরেকশনাল সাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে এক লাখ টাকা করে।

আলোচ্য প্রকল্পগুলোতে সাইনপোস্টগুলো তিন হাজারের ওপরে, কিলোমিটার পোস্টগুলো আট হাজারের ওপরে কিন্তু ১০ হাজারের নিচে, গাইড পোস্টগুলো নির্মাণে ২২০০ টাকার ওপরে ও ২৫০০ টাকার নিচে নির্মাণখরচ ধরা হয়েছে।

 

 

আরপি/এমএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top