রাজশাহী বুধবার, ১৬ই অক্টোবর ২০২৪, ১লা কার্তিক ১৪৩১


অতি বিনিয়োগে সংকটে বিদ্যুৎ খাত


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২০:৪৬

আপডেট:
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:০৯

ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজনের বেশি বিনিয়োগ করে এখন সংকটে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত। ২০২০ বা ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে যে চাহিদা তৈরি হবে, এখনই তা পূরণ করার সক্ষমতা রয়েছে। এরপরও নতুন অনেক কেন্দ্র রয়েছে পাইপলাইনে। এসব কেন্দ্র চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছর শুরুতে উৎপাদনে আসবে।

সরকারি হিসাব বলছে, দেশের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত কেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ১৯ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, এখন সান্ধ্যকালীন মোট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। আর দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার পিজিসিবি গ্রিডে ১০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন করছে। এই হিসেবে সান্ধ্যকালীন অলস পড়ে থাকছে ৬ হাজার ৭৫৭ মেগাওয়াট। অর্থাৎ এখন তীব্র গরমের সময়ই ৩৫ ভাগ বিদ্যুতের কাজ নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার শীতে অন্তত ৬৫ ভাগ কেন্দ্রকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাইরে থাকতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন করুক বা না করুক, তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। যাকে বলা হয়, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট। সুতরাং পিডিবিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলেও ঠিকই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে দুই দিক থেকে ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত, এই খাতে অতি বিনিয়োগ হওয়ায় অন্যখাতে বিনিয়োগ প্রবাহ কমছে। দ্বিতীয়ত, চাহিদা নিরূপণের ব্যর্থতার কারণে কেন্দ্র বসিয়ে রেখে অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে।

ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়ে পিডিবির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিনিয়োগের ওপর ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়। সরকারি-বেসরকারি—দুই ধরনের কেন্দ্রের জন্যই ক্যাপাসিটি চার্জ আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক আর না হোক, কেন্দ্র করতে যে খরচ হয়, সেটি ওঠাতেই হবে। সেজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়। তিনি বলেন, প্রতি কিলোওয়াট /ঘণ্টা (৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ধরে) গড়ে ২ টাকার মতো পড়ে। এটি পূর্ণসময় চলা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে। কিন্তু যদি কেন্দ্রটি পূর্ণ সময় না চলে, তাহলে অনেক সময় ৪০ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ধরা হয়, তখন ৪ টাকা, আবার যদি আরও কম চলে অর্থাৎ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর যদি ২০ শতাংশ ধরে ক্যাপাসিটি চার্জ ৮ টাকা হয়ে যাবে। আনুপাতিকহারে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা এই কর্মকর্তা বলছেন, চাহিদা নেই তবু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে যাচ্ছে সরকার। যখন সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাবে না, তখনই প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর কমে যাবে, বেড়ে যাবে ক্যাপাসিটি চার্জ। যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু বিদ্যুৎকেন্দ্র করা উচিত ছিল। অতি বিনিয়োগ হলে তার ক্ষতিকর প্রভাব তো পড়বেই। এখন যেখানে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মেগাওয়াট দরকার, সেখানে ১৮/১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। তাই ক্যাপাসিটি চার্জও বেশি।


পিডিবি যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, দেশে মোট তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬ হাজার ৬৯৩ মেগাওয়াট। যার মধ্যে ২৫ দশমিক ৬৫ ভাগ রয়েছে ফার্নেস অয়েলচালিত। এর পরিমাণ ৪ হাজার ৪৮৮ মেগাওয়াট। আর ডিজেলচালিত কেন্দ্রর পরিমাণ ১১ দশমিক ৫৭ মেগাওয়াট। যার পরিমাণ ২ হাজার ২০৫ মেগাওয়াট। সরকার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা করেছিল, তাতে সর্বোচ্চ ১০ ভাগ চালিত কেন্দ্র থাকার কথা বলা হয়েছে। এখন যা রয়েছে ৩৭ দশমিক ২২ ভাগ। হতাশার কথা হচ্ছে, মহাপরিকল্পনা তৈরির পর গত দুই বছরে ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প আখ্যা দিয়ে বেশিরভাগ তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, এই ধরনের আরও ৮টি কেন্দ্র এখন নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। যেগুলো আগামী বছরের জুনের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা।যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৮৯৭ মেগাওয়াট।এর বাইরে ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে আরও দুটি কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। তাও তেলচালিত। এই দুটি কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৬২ মেগাওয়াট। আগামী নয় মাসের মধ্যে তেলচালিত আরও ১ হাজার ১৫৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে যাচ্ছে।

সরকার বলছে, বছরে বিদ্যুতের ১০ ভাগ চাহিদার প্রবৃদ্ধি ঘটছে। সরকারের এই দাবি অনুযায়ী, ২০২০ সালের গ্রীষ্মে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদা সৃষ্টি হবে ১ হাজার ২৩০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ মোট চাহিদা হবে ১৩ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট। এর পরের বছর ২০২১ সালে ১০ ভাগ বর্ধিত চাহিদা হিসাব করলে পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াট। মোট পরিমাণ হবে ১৪ হাজার ৮৫৩ মেগাওয়াট।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গ্রীষ্মে ৪০ ভাগ আর শীতে ৬৫ ভাগ কেন্দ্র যেখানে বন্ধ থাকছে, সেখানে এই বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা কী তা, বোধগম্য নয়।’ তিনি মনে করেন বিনিয়োগের আগে কতটা আমাদের প্রয়োজন তা বিবেচনা করা উচিত।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ‘যারা এই ধরনের বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাদের ওপর অতিরিক্ত বিদ্যুতের মূল্যের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। এই ধরনের অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের এই পরিকল্পনায় ঝুঁকি নয় ক্ষতি হয়ে গেছে। এই ক্ষতিপূরণ এখন কীভাবে হবে, সেটাই বিবেচনা করা দরকার।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘এটিকে ব্যাড প্ল্যানিং বলে। পরিকল্পনাকারীরা বিদ্যুতের যে উৎপাদনের পাশাপাশি দেশের উন্নতি যে পরিমাণ চিন্তা করছিলেন, সে পরিমাণ হয়নি। তারা ভেবেছিলেন, বিদ্যুতের চাহিদা ধীরে ধীরে আরও বাড়বে। কিন্তু তাদের আশার তুলনায় কম বাড়ায় আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংকটের সময় আনা হয়েছিল। এখন সেগুলো বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। বন্ধ না করে চালানো হলে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ একটি বড় অংশ আমাদের বের হয়ে যাবেই। আমদানির করা গ্যাস ও তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনটি বেশি লাভজনক, সেটি যাচাই করা দরকার। কয়লার বিষয়টিও আমাদের বিবেচনা করা দরকার। বড় কেন্দ্রগুলো বিষয়ে জোর দিতে হবে অবশ্যই।’
এদিকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি বলেন, ‘যারা বিদ্যুতে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ঝুঁকির কথা চিন্তা করেই বিনিয়োগ করেছেন। যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের যারা অর্থ দেন, তারা ফিজিবিলিটি স্টাডি করেন। আগামী দশ বছরে বাংলাদেশের চাহিদা কী হবে, ২০ বছরে বাংলাদেশ এটি পূরণ করতে পারবে কিনা, তারা এসব চিন্তা করেই বিনিয়োগ করেন।’
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুতের প্রতিবছরের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১২ ভাগ। এটি ২০ ভাগ হয়ে যেতে পারে, যদি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ে । তখন আমরা কী করবো এই বিদ্যুৎ দিয়ে? সব সময় যে বিদ্যুতের উৎপাদন ৮ হাজার মেগাওয়াটই থাকতে হবে, তা তো নয়। কমপক্ষে ১০ ভাগ হাতে রাখতে হয়।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘আগামী দুই বছরের মধ্যে ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমাদের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন তো পড়বেই। ২০৪১ সাল পর্যন্ত আমরা যে ক্যালকুলেশন করেছি, তা একেবারে সঠিক। যদি শিল্প প্রবৃদ্ধি বাড়ে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে আরও একটি বিষয় আছে, শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া প্রয়োজন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হলে আমাদের আলাদা লাইন করতে হবে। আরও অনেক কাজ করবে।’ এগুলো নিয়ে এখন সরকার কাজ করছে বলেও তিনি জানান।

 

আরপি/এসআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top