রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


করোনাকালেও বদলায়নি রাজনৈতিক সংস্কৃতি


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২০ ১৮:২৫

আপডেট:
১২ জুলাই ২০২০ ১৮:২৬

 

 

করোনাভাইরাসের মহামারী বদলে দিয়েছে সব নিয়ম-কানুন, পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গন সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলেছে করোনাভাইরাস। সবকিছু বদলাতে পারলেও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। করোনাকালেও রাজনীতিতে ঐক্য নয়, বেড়েছে দূরত্বই। ভার্চুয়াল মাধ্যমে চলছে দোষারোপের রাজনীতি বা ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’।
একে অন্যের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। করোনা মহামারীর এ সময়ও দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এমন বিভেদের রাজনীতিতে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। মহামারীর এই সময়েও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়াকে দুঃখজনক বলছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্বের প্রায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো করোনা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। পাশের দেশ ভারতে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সমালোচনায় মুখর থাকলেও করোনা ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধ। করোনা মোকাবেলায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন। দেশের এ সংকট মোকাবেলায় সবার মতামত নিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, দেশটির পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একই পথ অনুসরণ করেছে। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের পরিবর্তে দোষারোপে ব্যস্ত।
জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, করোনাকালে সবার প্রত্যাশা ছিল আমাদের রাজনৈতিক রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটবে। অতীতের দূরত্ব কিছুটা হলেও মিটবে। দলগুলোর মধ্যে একটা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির পর একটা আশার আলো দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে করোনার প্রভাব খুব একটা পড়েনি। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতের মতোই ব্যস্ত বিষোদ্গারে। করোনাই যখন তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতিতে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমাদের কপালে দুঃখ আছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের প্রধান দুটি দলের মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থানটা নিবিড়। জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্যের প্রয়োজন বা দায়িত্ব রয়েছে সেটাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বিভাজন নয়। বিভাজনটা হল ক্ষমতাকেন্দ্রিক। কীভাবে ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকা যায় এবং কীভাবে ক্ষমতায় আসা যায়। মুখে মুখে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলে বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চলছে বাহাস। এটা হতাশাব্যঞ্জক।
তিনি বলেন, করোনাকালেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব না কমায় আমি অবাক হইনি। আমাদের রাজনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। বরং বিভাজনের রাজনীতি না হলে তাতে আমি অবাক হতাম। যদি চট করে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়ে যেত তাহলে অবাক হতাম। রাজনৈতিক দলের এমন কর্মকাণ্ডে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। রাজনীতিতে তারা নিজেদের খুঁজে পাচ্ছে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর গত কয়েক মাসের ভার্চুয়াল কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার ও বিরোধী দল কাদা ছোড়াছুড়িতেই ব্যস্ত। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হলে পরের দিন কিংবা ওইদিনই পাল্টা জবাব দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বিরোধী দলের সমালোচনা ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না সরকার। পক্ষান্তরে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগের প্রশংসা না করে সবকিছুতেই ভুল ধরছে বিএনপি। তাদের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের বড় একটি অংশজুড়েই থাকছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল।
সর্বশেষ ৯ জুলাই এক ভার্চুয়াল আলোচনায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের সংশোধন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার উদ্দেশ্য হল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বারবার ক্ষমতায় আনা। পরের দিন তার এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য আপত্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। সার্বভৌমত্ব ও সাংবিধানিক নিয়ম-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতা এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।
করোনা শুরুর দিকে ৪ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনে সরকারের কাছে প্রস্তাব করে বিএনপি। দুর্যোগ মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ২৫টি প্রস্তাব তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একইদিন বিএনপির প্রস্তাবকে ‘দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন’ বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে সব মানুষ যখন একযোগে এই সংকট মোকাবেলায় এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছে, তখন অর্বাচীনের মতো মির্জা ফখরুলের বক্তব্য জাতিকে বিভ্রান্ত করে।’
২৫ জুন জাতীয় করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সেলের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, ত্রাণ চুরির যে চিত্র দেশবাসী গণমাধ্যমে দেখেছে তাতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগারদের যেন কিছুতেই চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। এর জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, করোনার সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো সাজেশন তো বিএনপি রাখছে না, শুধু অন্ধ সমালোচনাকে রুটিন ওয়ার্কে পরিণত করছে।
৯ জুন উত্তরার নিজ বাসা থেকে ‘বাজেট ভাবনা : অর্থবছর ২০২০-২১’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলের বাজেট ভাবনা তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অর্থনীতির অস্বাভাবিক সংকোচনে প্রচলিত বাজেট ব্যবস্থা থেকে সরে এসে তিন বছরের মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার আলোকে বাজেট প্রণয়ন করার কথা বলেন তিনি। কিন্তু বিএনপির এই বাজেট ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ। বাজেট ঘোষণা এবং তা পাসের পর এর সমালোচনা করে বিএনপি। বিএনপির সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগের পাল্টা জবাব, বাস্তবসম্মত বাজেটের ব্যাপকতা ও সম্ভাবনা অনুধাবন করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়।
৬ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বিভাজন ও বৈরিতার রাজনীতি পরিহার করে করোনা প্রতিরোধের লড়াইয়ে সহযোগিতা করতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি নেতাদের কথা শুনে মনে হয়, পূর্ণিমার রাতেও তারা অমাবস্যার অন্ধকার দেখতে পায়। করোনা সংকটে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করে বিএনপি তাদের চিরাচরিত নালিশের রাজনীতি আঁকড়ে ধরে আছে। করোনাকালেও তারা আজগুবি তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।

 

আরপি/ এআর-০২



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top