রাজশাহী শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


রসায়নের মেধাবী ছাত্র থেকে বোমার কারিগর জাহিদ


প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২১ ১৫:৫১

আপডেট:
১৭ মে ২০২৪ ০৫:৩১

ফাইল ছবি

দেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাসে বোমা তৈরির দক্ষ কারিগর হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম জাহিদুল ইসলাম মিজান। জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) এই সদস্য একসময় 'বোমা মিজান' হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা মিজানসহ তিনজনকে ছিনিয়ে নেয়। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ভারতে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে দেশটির কারাগারে আছেন।

তবে বোমা মিজানের উত্তরসূরি হিসেবে মো. জাহিদ হাসান নামের এক যুবকের নাম বেরিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে পড়ূয়া এই মেধাবী ছাত্র অনলাইনে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন জঙ্গিদের।

সংগঠনে জাহিদের একাধিক ছদ্মনাম- রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে কাতারপ্রবাসী ফোরকান। ২০১৪ সালের পর থেকে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, রসায়নপড়ূয়া কোনো এক ব্যক্তি জঙ্গিদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। তবে তার নাম-পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল না তাদের কাছে।

সম্প্রতি মিরপুর থেকে সাব্বির ওরফে বামসি বারেক এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে আরেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বোমা মিজান-পরবর্তী দক্ষ কারিগরের ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য পান গোয়েন্দারা। একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জাহিদকে এখনও ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের ভাষ্য, জাহিদকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

সিটিটিসির প্রধান, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বোমা তৈরিতে দক্ষ এক জঙ্গির ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে; গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। উগ্রপন্থিদের যে কোনো তৎপরতা রুখতে আমরা নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। অনলাইন ও অফলাইনেও নজর আছে।

জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ওপর এক দশকের বেশি নজর রাখছেন এমন একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, গত কয়েক বছরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের আরও দু-এক এলাকায় কয়েক দফায় পুলিশ চৌকিতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। কোনোভাবে হামলায় ব্যবহূত বোমার সূত্র নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। তবে গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল, একই জায়গায় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে এসব হামলার ঘটনা ঘটছে। একপর্যায়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, ডেটনেটর ও সার্কিটযুক্ত এসব বোমা স্থানীয়ভাবে তৈরি। রসায়ন ভালো বোঝেন- এমন কেউ এসব তৈরির নেপথ্য কারিগর।

একজন কর্মকর্তা জানান, নানাভাবে তথ্য সংগ্রহের পর নিশ্চিত হওয়া যায়, জাবির ছাত্র জাহিদ বোমা তৈরির মূল ব্যক্তি। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রথম বর্ষে ভর্তি হন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা। স্নাতক সম্পন্ন করলেও মাস্টার্স সম্পন্ন করেননি তিনি। একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ডার্ক সাইটে উগ্র মতাদর্শভিত্তিক নানা লেখালেখি করতেন জাহিদ। এরপর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়ানোর ব্যাপারে দাওয়াত পান। একপর্যায়ে জঙ্গিবাদে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। পরে জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যেসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন, সেখানে সক্রিয় সদস্য হন জাহিদ।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নব্য জেএমবির পলাতক শীর্ষ নেতা মাহাদি হাসান জনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে জঙ্গিদের বোমা তৈরির কারিগরের। জন বর্তমানে দেশের বাইরে পলাতক। সংগঠনে বিশ্বস্ততার জন্য এরই মধ্যে 'ইমাম মাহাদীর সৈনিক' গ্রুপে 'ক্যাপ্টেন' পদে ভূষিত করা হয়েছে জাহিদকে। অনলাইনে ইদাত-১, ইদাত-২ ও ইদাত-৩ নামে সেল পরিচালনা করে সেখানে জঙ্গিদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন তিনি। একেকটি সেলে ১৫ থেকে ২০ জন রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। হলি আর্টিসানে হামলার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জঙ্গি মামুনুর রশিদ রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। বিভিন্ন সময় অন্তত পাঁচবার হিজরত করার চেষ্টা করেন জাহিদ। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য জাহিদ মার্শাল আর্টও শিখেছেন।

প্রসঙ্গত, ইদাত সেল থেকে বোমা তৈরিসহ হামলার বিভিন্ন কৌশল শেখা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বোমা হামলা ও প্রতিরোধ, পিস্তল ডিফেন্স (আত্মরক্ষা), ছুরি দিয়ে লড়াই করা এবং ছুরি হামলা প্রতিরোধ। এ ছাড়া টার্গেট করা ব্যক্তির হাত, পা, ঘাড় মটকে দেওয়া বা ভেঙে ফেলা। এমনকি খালি হাতে কীভাবে টার্গেট ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়া, পেট্রোল বোমা বানানো, আকস্মিক হামলা, মাথায় হামলা ইত্যাদি শেখানো হয়।

ডিএমপির বোমা নিষ্ফ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, বোমার আলামত পরীক্ষা করে সম্প্রতি একটি নতুন উপাদান পাওয়া যায়। তখনই আমরা প্রায় নিশ্চিত হই, রসায়ন ভালো জানা ছাড়া এমন বোমা তৈরি প্রায় অসম্ভব। এর পর থেকে জাহিদ নামের ওই বোমার কারিগরকে খোঁজা হচ্ছে। সে এখন আমাদের কাছে টপ ওয়ান্টেড।

 

 

আরপি/এসআর-০৪



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top