রাজশাহী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


বাংলাদেশেও অক্সিজেন সংকটের আশঙ্কা


প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০২১ ১৯:০৭

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১৬:১৮

 

হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, দেশে উৎপাদিত হয় তার চেয়ে বেশ কম। বড় একটি অংশ আমদানি করা হতো ভারত থেকে। দেশটিতে করোনা রোগী ব্যাপক সংখ্যায় বাড়তে থাকায় গত বৃহস্পতিবার থেকে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। ফলে বাংলাদেশে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এখন মজুদ থেকে তা পূরণ করা হচ্ছে। মজুদ শেষ হলেই দেখা দেবে অক্সিজেনের সংকট। এমন অবস্থায় দেশে রোগী বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর জন্য দৈনিক ১৬০ থেকে ১৮০ টন অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এক সপ্তাহ আগে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সময় এর পরিমাণ ছিল ২০০ থেকে ২২০ টন। এর মধ্যে দেশি কয়েকটি কোম্পানি সরবরাহ করে প্রায় ১৩০ টন। বাকি ৭০ থেকে ৮০ টন ভারত থেকে আমদানি করা হতো। ভারত এই সরবরাহ বন্ধ করায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

অবশ্য অক্সিজেনের চাহিদা নিরূপণ ও উৎস খুঁজতে গত শনিবার পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সময়ে সময়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে মতামত ও প্রতিবেদন দাখিল করবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, বর্তমানে রোগী কিছুটা কমে আসায় তেমন সংকট হচ্ছে না। কারণ আগে থেকে আমদানি করে অক্সিজেন মজুদ রাখা হয়েছিল। এর পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার টন। উৎপাদন সক্ষমতার পর যতটুকু ঘাটতি থাকে, তা ওই মজুদ থেকে পূরণ করা হচ্ছে। তবে রোগী বাড়লে সংকট তৈরি হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে অক্সিজেনের মূল জোগানদাতা লিন্ডে ও এক্সপেকট্রা নামের দুটি কোম্পানি। এর মধ্যে লিন্ডে গড়ে ৮০ টন এবং এক্সপেকট্রা ৩৮ টন অক্সিজেন সরবরাহ করে আসছে। সম্প্রতি এ দুটিসহ অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে সভা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সভায় বলা হয়, লিন্ডে নারায়ণগঞ্জে তাদের উৎপাদনকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ৭০ টন এবং চট্টগ্রামের কেন্দ্রে ২০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির নারায়ণগঞ্জ উৎপাদনকেন্দ্রের কম্প্রেশারের মোটর পুড়ে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে চট্টগ্রামের কেন্দ্রটি ৩ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ছিল। সেখানে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ টন অক্সিজেন উৎপাদন করা হতো। কারিগরি ত্রুটির কারণে সেটিতে মাঝেমধ্যে উৎপাদন বন্ধ থাকে। অন্যদিকে এক্সপেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড বিষয়ে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ২০ টন উৎপাদন করে এবং ১৮ টন ভারত থেকে আমদানি করে। আমদানি বাদ দিলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান ১১০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে।

এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আরও তিনটি অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এগুলোর মধ্যে সীতাকুণ্ডে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেডের প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০ টন। তবে চিকিৎসায় ব্যবহার উপযোগী অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ টন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসায় ব্যবহার উপযোগী অক্সিজেন বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্তও নয়। দ্বিতীয়টি নারায়ণগঞ্জের ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড। তাদের প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা ৭০ টন। এর মধ্যে তরল অক্সিজেন ৪০ টন। আরেকটি হলো নারায়ণগঞ্জের এ কে অক্সিজেন (প্রা.) লিমিটেড। তাদের প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা ২০ টন। পরের দুটি আগে থেকেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনপ্রাপ্ত। আর আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেডকে জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় সাময়িক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছে, আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেড প্রতিদিন সাত টন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে। ইসলাম অক্সিজেন পারবে ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লিমিটেড ৮ টন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে। এ হিসাবে তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন পাওয়া যাবে ৩৫ টন অক্সিজেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্র বলছে, এই তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ টনের বেশি অক্সিজেন পাওয়া সম্ভব হবে না। এ হিসাবে পাঁচটি কোম্পানি মিলে ১৩০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে লিন্ডে ও এক্সপেকট্রা ছাড়া অন্যরা চিকিৎসা মানের (মেডিকেল গ্রেড) অক্সিজেন উৎপাদন করছিল না। তবে বর্তমান চাহিদার কারণে তাদের দিয়ে তা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। তারপরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন নিয়ে বর্তমান চাহিদাই পূরণ করা সম্ভব হবে না।

লিন্ডের মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ) সায়কা মাজেদ বলেন, বর্তমানে আমরা শিল্পে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রেখেছি। উৎপাদনের পুরোটা হাসপাতালে সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন রোগীর চাপ একটু কম আছে। এ কারণে অক্সিজেনে সংকট হচ্ছে না। রোগীর সংখ্যা না বাড়লে বর্তমান ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে। তবে রোগী বেড়ে গেলে সংকট তৈরি হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, কয়েকদিন ধরে রোগী কমে আসছে। ধারাবাহিকভাবে রোগী কমে এলে ভারত রপ্তানি বন্ধ রাখলেও সংকট হবে না। কিন্তু রোগী বাড়লে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। তবে সরকার বিকল্প পদ্ধতিতে অক্সিজেন উৎপাদনের চেষ্টা করছে। প্রয়োজন হলে শিল্পে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে হাসপাতালে সরবরাহ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া অধিকাংশ অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এতে সরকার তাদের সহায়তা করছে।

ঘাটতি মেটানো যেতে পারে যেভাবে

অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হলে তা কীভাবে মেটানো যেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন. বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুর থেকে অক্সিজেন আমদানি করা যেতে পারে। তবে নদীপথে ওই অক্সিজেন দেশে পৌঁছাতে প্রায় দুই মাস সময় লাগবে। বিমানে আনা হলে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পরিমাণে কম হবে। ভালো উপায় হচ্ছে, অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপন করা। একটি জেনারেটর থেকে প্রতিদিন ২৪ থেকে ২৫ হাজার লিটারের মতো অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব। জার্মানির সহায়তায় ভারত এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন উৎপাদন শুরু করেছে। একটি হাসপাতালে জেনারেটর বসানো হলে তা থেকে আইসিইউর মতো ৭০ থেকে ৮০টি শয্যায় অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ১০০ থেকে ১২০টি সাধারণ শয্যায় অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। সংকট দূর করতে এটি বিকল্প প্রক্রিয়া হতে পারে।

বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, সার্বিক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের নূ্যনতম পরিকল্পনাও ছিল না। করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। অন্যথায় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা করেনি। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা, আইসিইউ থেকে শুরু করে অন্যান্য সামগ্রীর মতো অক্সিজেন নিয়েও তারা একই কাজ করেছে। এখন ভারত অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করায় বাংলাদেশও বিপদে পড়তে যাচ্ছে। দ্রুত বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

ভয় জাগাচ্ছে ভারতীয় ধরন

বাংলাদেশে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের ধরনের অস্তিত্ব মিলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন আক্রান্তদের ৮১ শতাংশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন শনাক্ত হয়েছে। এ ধরনটি আগের তুলনায় ৭০ শতাংশ সংক্রমণপ্রবণ এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে সম্প্রতি ভারতে শনাক্ত হওয়া ডাবল ও ট্রিপল মিউটেন্ট আরও ভয়াবহ। দেশটির কয়েকটি রাজ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অক্সিজেন সংকট চরমে পৌঁছেছে। অক্সিজেন না পেয়ে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও বেড়ে চলছে। অক্সিজেন সংকট দূর করতে জার্মানি ও সৌদি আরব দেশটিকে সহায়তা করছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। ওই দুটি দেশের তুলনায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বেশি ঘনিষ্ঠ। প্রতিবেশী দুটি দেশের মানুষ সব সময় যাতায়াত করে। এ হিসাবে ভারতে শনাক্ত হওয়া অতি সংক্রামক ভাইরাসের ধরনটি বাংলাদেশে আসবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে সরকার আগামী ১৪ দিন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছায়, সেটি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ভারতে শনাক্ত হওয়া নতুন ধরন নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। কারণ, প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। বাণিজ্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। ভারতে শনাক্ত হওয়া নতুন ধরনের সংক্রমণ যাতে বাংলাদেশে সংক্রমিত হতে না পারে, সে জন্য দুই সপ্তাহের জন্য যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই ধরন দেশে পৌঁছালে তা ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করবে। সুতরাং দুই সপ্তাহ পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

কমিটি গঠন

অক্সিজেন সরবরাহের উৎস খুঁজতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) নাজমুল হক খানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। উপসচিব মোহাম্মদ রোকন উদ্দিনকে এতে সদস্য সচিব করা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন যুগ্ম সচিব (স্বাস্থ্য অধিশাখা) বেগম উম্মে সালমা তানজিয়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (হাসপাতাল) ডা. খুরশীদ আলম এবং সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. হাবিব ইসমাইল ভূঁইয়া।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব জাকিয়া পারভীন স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, কমিটি অক্সিজেনের চাহিদা নিরূপণ ও সরবরাহের উৎস চিহ্নিত করবে। একই সঙ্গে কোনো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সময়ে সময়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে মতামত ও প্রতিবেদন দাখিল করবে।

 

 

আরপি / আইএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top