রাজশাহী রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ই আশ্বিন ১৪৩১


বিশ্বের বিপন্ন ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ বাংলাদেশের


প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:৪৫

আপডেট:
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫২

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হারিয়ে যাওয়া ভাষা খুঁজে বের করে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সেজন্য ‘শিক্ষা হাসিনা ভাষা-গবেষণা ট্রাস্ট’ গঠনে উদ্যোগী হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ট্রাস্টের অধীনে বিশ্বের বিপন্নপ্রায় ও লিখন-বিধিহীন ভাষাগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রমিতায়নে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মাতৃভাষায় গবেষণাবৃত্তি, ভাষিক দক্ষতা অর্জন, ভাষা প্রশিক্ষণ এবং বিপন্নপ্রায় ভাষা সংরক্ষণে এ ট্রাস্ট থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে।

ট্রাস্টের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষাগুলোর আর্কাইভ, ভাষা-জাদুঘর, ডিজিটাল ল্যাব তৈরি করা হবে। ভাষাভিত্তিক গবেষণার লক্ষ্য ইনস্টিটিউটের আওতায় একটি ট্রাস্ট ফান্ডে বরাদ্দ বা সিড মানি দেবে সরকার। যার ইন্টারেস্ট থেকে বিভিন্ন ফেলোশিপ দেওয়া হবে। ট্রাস্টের তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিনিয়োগ করতে পারবে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তবে তার আগে ট্রাস্টের অনুমোদন লাগবে।

ট্রাস্টটি আইনে পরিণত করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের যেকোনো মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি অনুমোদন হতে পারে। এরপর জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পরই সেটি আইনে পরিণত হবে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায় অনুযায়ী এ ট্রাস্টটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে চলবে। এ ট্রাস্টটি আইনে পরিণত করতে আমরা মন্ত্রিসভায় সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে পাঠিয়েছি। খুব শিগগিরই এটির অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।

সচিব বলেন, ভাষা গবেষণা, সংরক্ষণ এবং এ খাতের উদ্যোগীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথম কাজ হবে এটি। মাহবুব হোসেন, সচিব-মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ

জানা গেছে, ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আমাই) গবেষণাবৃত্তি (ফেলোশিপ) প্রদান ও ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা দেন।

ওইদিন প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে আরও শক্তিশালী করতে চাই। এরপর এ ট্রাস্ট করতে উদ্যোগী হয় সরকার। যা এখন আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।

ট্রাস্টের অধীনে ভাষা-গবেষণা, ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ফেলোশিপ দেওয়া হবে। সব ধরনের বৃত্তি/ফেলোশিপ, অনুদান, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির সংখ্যা, হার, পরিমাণ নির্ধারণ করবে ট্রাস্ট।

ট্রাস্টের খসড়ায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগার বিশ্বের লিখন-বিধি আর্কাইভ ও ভাষা-জাদুঘর সমৃদ্ধকরণের লক্ষে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে। আমাই’র গবেষণা নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত গবেষণা কার্যক্রমে ট্রাস্ট থেকে সহায়তা করা হবে। পাশাপাশি ট্রাস্টের তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিনিয়োগ করবে।

এ টাস্ট্রের প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা হয়েছে- বিভিন্ন চর্চা, গবেষণা না হওয়ায় বিশ্বের অনেক ভাষা প্রায় বিলুপ্ত। আবার এসব ভাষা সংরক্ষণে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান না থাকায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এ ভাষাগুলো।

হারিয়ে যাওয়া এসব ভাষা খুঁজে বের করা এবং বিদ্যমান ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেখ হাসিনা ভাষা-গবেষণা ট্রাস্ট’।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে ট্রাস্টটি চালানো হবে। সেজন্য একটি স্বতন্ত্র আইন করতে হবে। এ ট্রাস্টের খসড়া আইন চূড়ান্ত করতে গত ৭ জানুয়ারি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সভায় মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব, আমাই’র মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

আইনে বলা হয়েছে, ট্রাস্টের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং হেফাজতকরণ, ট্রাস্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। ট্রাস্টের অধীন গবেষণালব্ধ বিষয়গুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার-প্রকাশনার কাজ করবে।

বিষয়টি স্বীকার করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনিস্টিটিউটের (আমাই) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

ট্রাস্ট গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলেন, সরকার পরিবর্তন হলে অনেক কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এ রকম করতে না পারে সেজন্য এটিকে ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে।

যেভাবে পরিচালিত হবে ট্রাস্ট: ট্রাস্টি বোর্ডের একটি উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন ট্রাস্টের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সদস্য হবেন- অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে অন্য কোনো মন্ত্রী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যকে এ ট্রাস্টের সদস্য হিসেবে মনোনীত করতে পারবেন।

মনোনীত ব্যক্তি সভাপতি হবেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি হবেন শিক্ষামন্ত্রী। এ বোর্ডের অন্য সদস্যরা হবেন— প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

সদস্য তালিকায় আরও থাকবেন— বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি, সরকার থেকে মনোনীত অন্তত দুইজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, দুইজন ভাষাশিক্ষা বিশেষজ্ঞ, অফিস প্রধান ও বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক/পরিচালক সদস্য সচিব হবেন। মনোনীত সদস্যরা মনোনয়নের তারিখ থেকে তিন বছর পর্যন্ত নিজ পদে বহাল থাকবেন। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরকার মনোনীত সদস্যকে কোনোরূপ কারণ দর্শানো ছাড়াই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে।

খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, ট্রাস্টের কার্যাবলিভুক্ত যেকোনো কার্যক্রম পরিচালনা সহায়তার জন্য ট্রাস্টি বোর্ড প্রয়োজনে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করতে পারবে। ট্রাস্টি বোর্ড কর্মপরিধি নির্ধারণ করে নির্ধারিত সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে পারবে। প্রতি ছয় মাসে বোর্ডের অন্তত একটি সভার আয়োজন করতে হবে।

ফান্ড সংগ্রহ হবে যেভাবে: ট্রাস্ট পরিচালনায় স্থায়ী এবং চলতি তহবিল গঠন করা হবে। আইন পাস হওয়ার পরে সরকার ট্রাস্টের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেবে। এছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদনক্রমে দেশি/বিদেশি ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করা যাবে।

স্থায়ী তহবিলের অর্থ তফসিলি ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। ট্রাস্টের কোনো কাজ সম্পাদনের উদ্দেশে ওই তহবিলের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। তবে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনক্রমে ভাষা শিক্ষা, ভাষা প্রশিক্ষণ, প্রচার, প্রকাশনা ও গবেষণার লক্ষে ওই তহবিলের অর্থ ব্যয় করা যাবে।

ট্রাস্টের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে বোর্ডের অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বিদ্যমান জনবলের মধ্য থেকে নিয়োগ করতে পারবে। ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করবেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০০১ সালে ১৫ মার্চ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি এ. আনানের উপস্থিতিতে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

২০১০ সালের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নবনির্মিত ইনস্টিটিউট ভবন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। আমাই আইন (২০১০) অনুযায়ী তিনি এ প্রতিষ্ঠানের মুখ্য পৃষ্ঠপোষক।

ট্রাস্ট আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মাতৃভাষায় গবেষণাবৃত্তি, ভাষিক দক্ষতা অর্জন, ভাষা প্রশিক্ষণ এবং বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলো সংরক্ষণের লক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শেখ হাসিনা ভাষা-গবেষণা ট্রাস্ট গঠনে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। আইন পাস হওয়ার পরে বিধান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘শেখ হাসিনা ভাষা-গবেষণা ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট সরকারি আদেশ দ্বারা স্থাপন করা হবে।

ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয় হবে আমাইতে। ট্রাস্টি বোর্ড প্রয়োজনে সরকারের অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশের বাহিরে বিশ্বের যেকোনো স্থানে শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে। 

 

আরপি / এমবি-২



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top