নিয়োগবিধিতে অসন্তোষ প্রাথমিক শিক্ষকদের
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের জন্য প্রস্তাবিত নিয়োগবিধি নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে একটি 'যৌক্তিক' নিয়োগবিধির দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু চূড়ান্ত হতে যাওয়া নিয়োগবিধি নিয়ে তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, নতুন বিধিতে সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে পদোন্নতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
নতুন নিয়োগবিধিটি গত সপ্তাহে প্রশাসন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে অনুমোদিত হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিইও) পর্যন্ত হতে পারতেন। কিন্তু কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগবিধি ১৯৮৫ শিক্ষকদের পদোন্নতির পথ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে পিএসসির নিয়োগবিধি ১৯৯৪ জারি হলে এটিইও পদে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকরা বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করতে পারতেন। ২০০৩ সালে সরকারি গেজেটেও এটিইও পদে বিভাগীয় প্রার্থী বলতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের কথা বলা ছিল এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বুঝানো হয়েছে। সর্বশেষ নিয়োগ পর্যন্ত এভাবেই চলছে।
এবার সচিব কমিটিতে পাস হওয়া নিয়োগবিধি ২০১৯-এ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থীর সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই বিধিমালা এভাবে চূড়ান্ত হলে সহকারী শিক্ষকরা জীবনে আর কখনও অফিসার পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে আবেদন করতে পারবেন না।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন বলেন, 'সবাই বলে শিক্ষকদের অনেক সম্মান, তাদের মর্যাদা অনেক ওপরে, এসব কথা শুধু মানুষের মুখে মুখে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।'
তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালের আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে শিক্ষা অফিসার হতে পারতেন। এরপর কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগবিধি ১৯৮৫ পাস হওয়ার পর এই সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালের সংশোধিত নিয়োগবিধিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা সরাসরি পদোন্নতি না পেলেও বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার বা উপজেলা শিক্ষা অফিসার হতে পারতেন। কিন্তু নিয়োগবিধি-২০১৯ সচিব কমিটিতে পাস হওয়ার পর সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি দূরে থাক, বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে আবেদন করারও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
কী আছে নিয়োগবিধিতে: সচিব কমিটিতে পাস হওয়া নিয়োগবিধিতে আছে- 'সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ২৫৮৯টি পদে সরাসরি নিয়োগ হবে। নিয়োগে ৮০ শতাংশ পদ বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং ২০ শতাংশ পদ উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে পূরণ করা হবে। বিভাগীয় প্রার্থী বলতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বুঝাবে। বিভাগীয় প্রার্থীদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ন্যূনতম তিন বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদগুলো উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে পূরণ করা হবে। সরাসরি নিয়োগে উন্মুক্ত প্রার্থীদের বয়স অনূর্ধ্ব ৩০ বছর। তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ৪৫ বছর পর্যন্ত শিথিলযোগ্য।'
অফিসারদের আর একটি পদ ইন্সট্রাক্টর (উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টার)। এর ৫০৫টি পদের নিয়োগে মোট পদের ৩৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৬৫ শতাংশ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। তবে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। পদোন্নতির জন্য উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইন্সট্রাক্টর/পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে ন্যূনতম সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণির বিএডসহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি। সরাসরি নিয়োগে বয়স ৩০ বছর, তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের বয়সের কোনো উল্লেখ নেই।
ইউআরসি সহকারী ইন্সট্রাক্টরের ৫০৫টি পদে নিয়োগও একই নিয়মে। তবে এখানেও বিভাগীয় প্রার্থী বলতে শুধু প্রধান শিক্ষকদের বুঝানো হয়েছে।
দেশের ৬৭টি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) সাধারণ ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ইন্সট্রাক্টর পদেও প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভাগীয় পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়নি।
শিক্ষকরা যা বলেন: সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার মৈশাষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, উচ্চপদে বর্তমান নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষকের বিভাগীয় আবেদনের সুযোগ না রাখলে মেধাবী ও যোগ্য লাখ লাখ সহকারী শিক্ষক হতাশায় ভুগবেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নতুন যোগদান করা সহকারী শিক্ষকরা এই ডিপার্টমেন্টকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করবেন, যা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ময়মনসিংহ সদরের চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহমুদুল হাসান রুমী বলেন, উচ্চপদে পদোন্নতির স্বপ্ন নিয়েই এই ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেছি। আমাদের স্বপ্ন যেন ভেঙে দেওয়া না হয়।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ আলীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেহানা সুলতানা মনি বলেন, নতুন নিয়োগবিধি কার্যকর হলে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষায় আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। প্রাথমিক শিক্ষার মান কমে যাবে। ফলে শিক্ষার ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়বে। দক্ষ শিক্ষকদের অফিসার পদে সুযোগ দিলে শিক্ষার মান আরও বাড়বে।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার দক্ষিণ সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান বাবুল বলেন, সহকারী শিক্ষকরা বেশিরভাগ সময়েই পদোন্নতি পান না। এতে তাদের কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। সরকারের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে কোনো প্রকার শর্ত ছাড়াই ব্যক্তি তার নিজ নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে এত টালবাহানা কেন?
শিক্ষক নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন বলেন, এই নিয়োগবিধি সংশোধন করে সবার সমান সুযোগ রেখে নতুন নিয়োগবিধি করা হোক। ডিপার্টমেন্টের বাইরে থেকে কর্মকর্তা পদে নতুন নিয়োগ দিলে তা প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি অবিচার করা হবে। এটা আমরা কখনোই মেনে নেব না। অফিসার ও ইন্সট্রাক্টর পদে শতভাগ পদোন্নতি দিতে হবে। এর মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ সিনিয়রিটির ভিত্তিতে ও অবশিষ্ট ৫০ ভাগ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক কর্মচারীদের বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে দিতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) রতন চন্দ্র পণ্ডিত শিক্ষকদের দাবি বা হতাশার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, 'প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশোধিত নিয়োগ বিধিমালা সব ধাপে চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে। মন্ত্রিসভা থেকে এলে ছোটখাটো কিছু কাজ আছে সেসব শেষ করে সংশোধিত নিয়োগ বিধিমালা বাস্তবায়ন করা হবে।'
তিনি বলেন, '১৯৮৫ সালের পরে এ নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করা হয়নি। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। সেসব সমাধানের মাধ্যমে এ নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অফিস সহায়ক থেকে মহাপরিচালক পর্যন্ত ৭৬টি পদে নিয়োগ-পদোন্নতি ও কর্মকর্তাদের গ্রেড সংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ রয়েছে।'
আরপি/এসআর-১০
বিষয়: প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগবিধি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: