রাজশাহী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বিকাশে অভিভাবকের করণীয়


প্রকাশিত:
২৫ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:৫৫

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৬

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই কিছু সীমাবদ্ধতার জায়গা থাকে। যেগুলোকে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়। ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোনগুলো ঠিকমতো স্পর্শ করছে কি-না শিশুটি, সেগুলো বোঝার চেষ্টা করাটাই প্রথম কাজ। ছোট বাচ্চার ঘাড় শক্ত হয়েছে কি-না, পেটের উপর শুয়ে মাথা উঁচু করছে কি-না কিংবা খুব খুশি হয়ে হাত-পা নড়াচড়া করছে কি-না এগুলোই সাধারণত দেখা হয়। শিশুরা এ সময় হাত মুখে নিয়ে আসার ক্ষমতা অর্জন করে।


তিন মাসের মধ্যেই সাধারণত মোটর ডেভেলপমেন্ট মাইলস্টোন পূরণ করার দক্ষতা অর্জন করে। তারপর ধীরে ধীরে শিশুটি নির্দিষ্ট বয়সে হামাগুড়ি দেয়ার চেষ্টা করে। উঠে বসার চেষ্টা করে। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে সবাইকে তার দিকে আকৃষ্ট করে ও চারপাশ থেকে শেখার চেষ্টা করে। এরপর কথা বলার চেষ্টা করে শিশুটি। এভাবেই বয়স অনুযায়ী শিশু মাইলস্টোনগুলো স্পর্শ করে। তারপর আসে সে ঠিকমতো খেলা করছে কি-না কিংবা অন্য শিশু ও বড়দের সঙ্গে খেলছে কি-না এগুলো দেখা হয়।

যদি শিশু স্পিচ, ল্যাঙ্গুয়েজ, সোশ্যাল স্কিলস এগুলোতে বিলম্বিত হয় কিংবা খেলাধুলা ও অন্যের সঙ্গে মেলামেশা না করে তাহলে ভাবনার বিষয়। অনেক সময় অটিজম ছাড়াও এসব মাইলস্টোনগুলো বিলম্বিত হয়ে থাকে। দেখা যায়, শিশুদের নিয়ে খুব একটা প্রকৃতির কাছে যাওয়া হয় না বা তাদের বিকাশ প্রকাশের জন্য যেসব কার্যক্রম আছে দৌড়ানো, লাফানো, ঝাপানো এগুলো করতে দেয়া না হলেই ঘটে এমন ঘটনা। এটা ঠিক নয়।

এগুলো করলে শিশু সমাজ ও পরিবেশ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। তার ছোট আঙুলগুলো দিয়ে সে কীভাবে কাজ করে, ছোট ছোট জিনিস উঠাতে পারে কি-না, পেন্সিল ঠিকমতো ধরতে কিংবা লিখতে পারছে কি-না এগুলো দেখা হয়। আজকাল অনেক বেশি জোর দেয়া হয় বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুর লেখার উপরে।

যদি কোনো শিশু ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোন অনুযায়ী ঠিকমতো বড় না হয়; তাহলেই চিন্তার বিষয়। ৩-৪ মাস পার্থক্য হতেই পারে। যদি কোনো শিশুর বয়স অনুযায়ী বিকাশ না ঘটে এবং এসব সমস্যার মুখোমুখি হলে বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও একটু অসুবিধা আছে।

শিশুরা তাদের নিজ পরিবেশ থেকে প্রথমে দৌড়ানো, ঝাপানো, লাফানো এগুলো শেখে। তাদের শেখার সময় শুরু হয় ০-৬ বছর পর্যন্ত। এ সময় যদি শিশু এগুলো কিছু করার সুযোগ না পায়; তাহলে অনেক সময় তার বিকাশ ঘটবে না। অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের (টিভি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি) সামনে থাকলেও এরকম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তবে এ সময়ের মধ্যে বাচ্চা যত দৌড়াবে, লাফালাফি করবে, খেলবে; ততই সে চারপাশ থেকে শেখার চেষ্টা করবে। তবে পুরোটাই বড়দের নজরদারিতে থাকবে যাতে ব্যথা না পায়। এগুলোই শিশুর বিকাশের জন্য সঠিক রাস্তা। যত বেশি শিশুকে মুক্ত করে দেয়া যাবে; ততই সে শিখতে পারবে। শিশুর বয়স ঠিক ৬-৭ মাস পর থেকেই টের পাওয়া যায়। যদি লক্ষ্য করেন শিশুর বিকাশগুলো ঠিকমতো না হয়, তাহলে আমরা প্রথম থেকেই সচেতন হয়ে যাব।

যখন অভিভাবক বুঝতে পারেন, তার শিশুর একটু অসুবিধা হচ্ছে কিংবা বিকাশ ঠিকমত ঘটছে না; তখন প্রথম তারা একজন ডেভেলপমেন্টাল শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন। তিনি দেখার চেষ্টা করবেন, বাচ্চার সামাজিক বিকাশ, কথা বলার বিকাশ, চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষার বিকাশ, নিজস্ব বিকাশের কোথাও কোনো ঘাটতি আছে কি-না। বিশেষজ্ঞ ফিজিশিয়ান শিশুকে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের কাছে রেফার করতে পারেন; যদি তিনি মনে করেন।

অকুপেশনাল থেরাপিস্ট প্রত্যেকের কাজ সম্পর্কে যাবতীয় একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। শিশুটির অকুপেশন বা কাজটা কী হবে? খেলাধুলা, দৌড়ানো, লাফানো ইত্যাদি। শিশুটি যদি না খেলতে পারে; তাহলে চেক করে দেখতে হবে কী কারণে তার এই বিকাশে বিলম্ব হচ্ছে। শিশুর ভাষার ব্যবহারের উপরে আমরা সরাসরি কাজ করতে পারি না। তবে চেষ্টা করি খেলার মাধ্যমে তার ভাষা কিছুটা তৈরি করে দিতে। এভাবে ল্যাঙ্গুয়েজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা যায়।

এরপর যেটা দেখা হয়, শিশু কতটুকু সাড়া দেয় বা সে কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে কি-না। স্কুলের কথাই ধরি, কিছু শিশু আছে যারা লিখতে পারছে না। ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, শিক্ষকের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না ও সাড়া দেয় না, সেক্ষেত্রেও কাজ করে দেখা হয়। প্রতিটি শিশুই আলাদা। তাদের চাহিদাও ভিন্ন। প্রথমে দেখা দরকার, সে কোন ধরনের অসুবিধার মধ্যে আছে এবং কোন কাজগুলো করতে পারছে না? কেন পারছে না?

অনেক সময় দেখা যায়, সেনসরি ইন্টিগ্রেশন ডিফিকাল্টিজ থাকে। যাকে বলা হয় সেনসরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার। এগুলো হলো- স্পর্শ করে বুঝতে পারার ক্ষমতা, যেমন- শক্ত, নরম, মসৃণ ও অমসৃণ। এরপরে আসে ভেস্টিবুলার; যা দিয়ে কতটুকু নড়াচড়া, চলাফেরা, গতিবিধি পরিবর্তন, চলাফেরার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বা আরাম বোধ করছে কি-না এগুলো দেখা হয়।

এরপর প্রপ্রিওসেপশন, যার অর্থ হচ্ছে কত জোরে টান দেওয়া হচ্ছে, অবস্থান বা নড়াচড়া। ইন্টারসেপশন হলো, শরীরের ভেতরের অবস্থা বা অনুভূতি বোঝার বোধশক্তি। এ রিসেপ্টরগুলো শরীরের ভেতর থেকে তথ্য এনে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। যেমন- খিদে লাগা, পানির তেষ্টা পাওয়া, ব্যথা বোধ, তাপমাত্রা ইত্যাদি এটা দেখা হয়। এগুলোই হলো মূল শিক্ষা ব্যবস্থা।

এসবের মধ্যে যদি কোথাও কোনো সমস্যা হয়, যেমন- কোনো কিছু স্পর্শ করার ক্ষেত্রে দেখা যায় বাচ্চা একটু বেশি চাপ দেয়, তার খারাপ লাগতে পারে, ব্যথা লাগতে পারে, তার রাগ হতে পারে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুটি বুঝতে পারে না কতটুকু প্রেসার দেয়া উচিত। সারাক্ষণ দেখা যায় শিশুটি দৌড়াচ্ছে কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারে না। চারপাশের মানুষের অস্থিরতা বোঝার কোনো ক্ষমতাও তার থাকে না।

যদি এসব ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা মনে হয় বা সামাজিক যোগাযোগে আগ্রহ প্রকাশ না করে তাহলেও বুঝতে হবে শিশুটির সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, শিশু ঠিকমতো স্কুলে গিয়ে বোর্ড থেকে লেখা তুলতে পারছে না। উল্টো করে লিখছে, স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে একত্রে মিশে খেলছে না, ঠিকমতো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে না, এসব ক্ষেত্রে সেনসরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি প্রয়োগ করতে হয়।

অনেক সময় পারিবারিক অশান্তিতে বাবা-মা ঝগড়া করেন বাচ্চাদের সামনে। এতে শিশুর ডিপ্রেশন, অস্থিরতা, মন খারাপ থাকে। ঠিক তখন ফিজিশিয়ানের কাছে নিয়ে আসেন অভিভাবক। তখন এসব বাচ্চাদের সঙ্গে প্লে থেরাপি দেয়ার চেষ্টা করা হয়। খেলার ছলে তাদেরকে থেরাপি দেওয়ার ও মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় ঘরে শিশুদের ছবি আঁকা, রং করা, কবিতা পড়া ইত্যাদি করতে দেয়া হয় না; যার ফলে পিছিয়ে যায় শিশুটি। তার মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়।

সারাক্ষণ স্ক্রিন টাইম এ ব্যস্ত থাকে সে। এ কারণে তার মোটর স্কিল বা গুণাবলী প্রকাশ হয় না ঠিকমতো। প্লে থেরাপির মাধ্যমে প্রথমে দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেটাই পর্যায়ক্রমে ফাইন মোটর দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কাজ হচ্ছে, সবগুলো স্কিলের জায়গায় থেকে নির্দিষ্ট একটা বিভাগে কাজ করার; যেখানে শিশুটির সমস্যা আছে।

একইভাবে অভিভাবকদেরও এটা বুঝতে হবে, এটা কোনো মেডিকেল সেটআপ নয় যে ওষুধ দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এটা অনেকটা থেরাপি নির্ভর চিকিৎসা। এখানে খেলনার মাধ্যমে কথা বলানো, সোশ্যাল লার্নিং ও অন্যান্য শিক্ষামূলক জ্ঞান দেওয়া হয়। তাই প্যারেন্টসদের ধৈর্য ধরতে হবে। ফিজিশিয়ানের কাছে সাধারণত তিন থেকে চার বছরের শিশুরা এসে থাকে। তারপরও দেখা যায়, যেহেতু ডায়াগনোসিস বিভিন্ন সময় হতে পারে তাই সঠিক বয়সের গ্রুপটা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।

প্রথমদিকে চেষ্টা করা হয় সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার থেরাপি দেওয়ার। এরপরে যখন বাচ্চা একটু রেসপন্স করতে থাকে; তখন সপ্তাহে একবার, ১৫ দিনে একবার, মাসে একবার করে থেরাপির প্রোগ্রাম করা হয়। তবে ০-৬ বছরের মধ্যেই একটা ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয়। অনেক সময় দেখা যায়, যাদের ডায়াগনোসিস যত দ্রুত করা সম্ভব হয়; তাদের বিকাশও দ্রুত হয়ে থাকে।

ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে অনেকটা স্বাভাবিক হলেও অভিভাবকরা থেরাপি সমাপ্ত করেন না। কোথায় দ্রুত ফলাফল পাওয়া যাবে সেদিকে ছোটেন অভিভাবকরা। যার ফলে শিশুটিও তাদের মতো অস্থির আচরণ শুরু করে দেয়। যেটুকু গ্রহণ করে; সেটুকু ধরে রাখতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, শিশু স্পিচ, ল্যাঙ্গুয়েজে ভালো করলেও তাদের সামাজিক বিকাশ সেখানে আটকে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় সমাপ্ত করলেও দেখা যায়, বাইরে সবার সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে, কীভাবে মতামত আদান-প্রদান করবেন এসব বুঝতে পারেন না। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অসুবিধা ও দুর্বলতা সবকিছু একটু আলাদা হয়।

সামাজিক ব্যবস্থা এবং প্যারেন্টসের পক্ষ থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের ওপর একটু চাপ অবশ্যই থাকে। সবাই চায় তাদের বাচ্চাটি যেন প্রথম অবস্থানে থাকে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কেউ অঙ্কে ভালো করে, কেউ গান ভালো করে, কেউ ভালো ছবি আঁকে। অনেক সময় বাবা-মা এসে বলেন, তাদের শিশু লিখতে পারছে না, পড়তে পারছে না, কীভাবে এটা আরও ভালো করা যায়।

এক্ষেত্রে একজন ফিজিশিয়ান শিশুটিকে একটু কাউন্সেলিং করতে পারেন, বোঝাতে পারেন যে তুমি অনেক ভালো করছ। দেখা যাক, আরেকটু চেষ্টা করে বাবা-মার চাহিদা অনুযায়ী ভালো করা যায় কি-না। ঠিক একইভাবে প্যারেন্টসদেরও কাউন্সেলিং দেয়া হয়। কিছু প্যারেন্টস খুবই পরিষ্কার একটি ধারণা নিয়ে আসেন যে, তাদের বাচ্চা শুধু খুশি থাকবে অন্য কোনো কিছুই চাওয়ার নেই। পড়াশোনা থাকবে কিন্তু এর মানে এই না যে ও খুশি থাকবে না, মন খারাপ করে থাকবে।

এভাবে বললে শিশুটির মনে পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা স্ট্রেস বা চিন্তা থাকে না। আসল বিষয়টি হচ্ছে আমরা শিশুদের এত ক্লাস দিয়ে দিচ্ছি যে, গান শেখো, অঙ্কন শেখো, ব্যায়াম করো, খেলাধুলা করো। তবে বাস্তব জীবনে আমাদের যেটা সবচেয়ে জরুরি; তা হলো নিজের কাপড় নিজে পরা, নিজের খাওয়া সুন্দর করে খাওয়া, নিজের সবকিছু গুছিয়ে ও সুন্দর করে করতে পারা। নিজস্ব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধারণা থাকা ও সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করা- এগুলোই আসলে বিকাশের মূল জায়গা; যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুদের ফিজিশিয়ান বা থেরাপিস্টদের কাছে নিয়ে আসার আগে তাদের প্যারেন্টসদের আগে নিয়ে আসা দরকার। এখন অবস্থা এমন, প্যারেন্টসদের দুশ্চিন্তা এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা চলে আসছে তাদের দুই মাসের বাচ্চা এবং দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে। বলা হয়, তাকে ভালোবাসেন, কোলের মধ্যে রাখেন এতটুকুই যথেষ্ট। প্যারেন্টসরা এতে খুশি হন না। এগুলো তো করছেনই তারা, বরং আর কী কী করতে হবে তা জানার চেষ্টা করেন।

প্যারেন্টসদের দুশ্চিন্তার শিকার হচ্ছে তার শিশুটি। আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যদি কোথাও, কখনো, কোনো কিছুতে কোনো সমস্যা মনে হয় তখন থেরাপিস্টের কাছে আসতে বলা হয়। একটা কথাই বলার থাকে সব সময়, ‘বাচ্চাকে সময় দেন, বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটান’। সবার কথা বলা ঠিক না, তবে ৫০ শতাংশ অভিভাবক বলেন, ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি দিয়ে দেখতে কীভাবে শিশুর বিকাশ স্বাভাবিক করা যায়।

সারাক্ষণ বাচ্চাকে একটা কথাই বলতে হবে, ‘তুমি যে রকমই হও, যা-ই হও তুমি অতুলনীয়, তুমি এরকমই থাক এবং তুমি এটা পারবে’। যদি তার মধ্যে পড়াশোনা শিখতে অসুবিধা হয়; তাহলে তা ঠিক করতে যাওয়ার চিন্তা করাটাও ভুল। ও যে রকম আছে সে জায়গাটাকে আরও কার্যকরী করা যায় কি-না এটাই আমাদের প্রধান টার্গেট হবে।

প্রথমে প্যারেন্টসরা আসেন বাচ্চা কথা বলতে পারে না, কথা বলিয়ে দেন। থেরাপিস্টরা এর উপরে কাজ করার চেষ্টা করেন। এরপরে বলেন, কথা বলছে, পুরো বাক্য বলছে না। তারা সেটার উপর কাজ করেন। এরপর বলেন, তাদের লেখাপড়া করার দক্ষতা বাড়িয়ে দেন- এভাবে তারা বিভিন্ন থেরাপির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এগুলোতে বাচ্চার ৭-১০ বছরের সুন্দর একটা জীবন নষ্ট হয়ে যায়। ডেভেলপমেন্টের কাজগুলো তো অবশ্যই আমরা করব; তবে ধীর গতিতে, ভারসাম্য বজায় রেখে কাজগুলো করতে হবে।

বাচ্চার ডায়াগনোসিস হলে এ ধরনের অবস্থায় অবশ্যই বাবা-মা অস্থির হয়ে যাবেন। কিন্তু তারও একটি সীমা থাকবে। ডায়াগনোসিস হবে, ফিজিশিয়ানরা এটার উপরে কাজ করবেন বা করার চেষ্টা করবেন এবং ধীরে ধীরে শিশুটি রেসপন্স করবে। তবে তার মানে এই নয়, যখন যে জায়গায় যেতে বলবেন, সেখানেই বাচ্চাকে নিয়ে দৌড়াবেন, সারাক্ষণ তাদের দৌড়ের উপরে রাখবেন।

দেখা যায়, এতে পরিবারের মধ্যে বিক্ষিপ্ততা বাড়ে, সংসারও ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যতই সিস্টেমটা ব্যালেন্স অবস্থায় থাকবে বা সবকিছুতেই সমন্বয় থাকবে; তত তাড়াতাড়ি শিশুটির কাছ থেকে রেসপন্স বা সাড়া পাওয়া যাবে। একটু সময় দরকার হবে কিন্তু যদি আমি শিশুটিকে ভালোবাসি, আদর করি, জড়িয়ে ধরি, সময় দেই অবশ্যই রেসপন্স দেখতে পাবো। শিশুটির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই বলবে ও নিরাপদ থাকবে, ততোই বাচ্চা শিখবে।

আজকাল দেখা যায়, এডিএইচডি বা (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার’র ক্ষেত্রে খুব বেশি ভুল ডায়াগনোসিস হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি তাদের ওষুধ বা মেডিকেশন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে একটু ধ্যান দিলেই পরিষ্কার ব্যাপারটা বোঝা যায়। আমরা যখন ছোট ছিলাম এত সুগার বা প্রসেসড খাবার কিংবা রং-বেরঙের কোমলপানীয় খেতাম না। এতে আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করত।

এখনকার শিশুরা এ ধরনের খাবারের উপরেই আছে। দেখা যায়, এগুলোই অনেকাংশেই হাইপারঅ্যাক্টিভিটি কাজ করে থাকে। অনেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ও প্রিজারভেটিভ মিশ্রিত থাকে। যদি কোনো বাচ্চার মধ্যে হাইপারঅ্যাক্টিভিটি দেখা যায়; অবশ্যই তার খাওয়া-দাওয়ার উপরে নজর দেয়া উচিত। অনেক ধরনের গবেষণা থেকে এটাই প্রমাণ হচ্ছে খাদ্যতালিকার উপর জোর দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত- জরুরি ব্যাপার হচ্ছে ঘুম। আজকাল দেখা যায়, বাবা-মা দু’জনে কাজ করেন, ফিরতে তাদের রাত ১০টার বেশি বেজে যায়। তো বাচ্চা বারোটা একটার আগে ঘুমায় না। এটা ঠিক নয়। বাচ্চাকে ৮-৯টার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া উচিত। সেটা একটি রুটিনের মধ্যে থাকতে হবে। রাতে এসে বাবা-মা সময় কাটাবেন, এজন্য তাদের দুপুরে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এতে ভালো তো হয়ই না বরং শিশুটির সার্কেডিয়ান রিদম পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। রিদম অবশ্যই থাকতে হবে। সারকেডিয়ান রিদম হলো, একটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। যা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার চক্র পূরণ করে। জীবিত বস্তুর অস্তিত্বকে এক অদৃশ্য ছন্দে বেঁধে দেয় এ রিদম। রাতের ঘুমটাই ব্রেইন ঠান্ডা ও রিলাক্স করে। সেটা দিনের ঘুমে কখনোই পূরণ হবে না।

তৃতীয়ত, আউটডোর প্লে গেম। যখন কোনো প্যারেন্টসকে জিজ্ঞেস করা হয় আপনার বাচ্চা খেলাধুলা করে কি-না? তখন তারা বলেন, সময় কোথায়, পড়াশোনা করছে শুক্রবার, শনিবার আমাদের ছুটি থাকে তখন আমরা এক-দুই ঘণ্টার জন্য মার্কেটে বা খেতে নিয়ে যাই। প্রকৃতির আলো-বাতাসের মতো রাতের ঘুমটাও জরুরি। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হবে।

এটা যে গঠনমূলক হতে হবে তা কিন্তু ঠিক না। খেলাধুলার মাধ্যমে করতে হবে। স্ক্রিন টাইম কমাতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, সারাদিন টিভি চালু অবস্থায় আছে, কেউ দেখুক বা না দেখুক। শিশুর অ্যাটেনশন সম্পূর্ণরূপে নিতে গেলে টিভিকে বন্ধ রাখতে হবে।

আসলে আমাদের জীবন ব্যবস্থাটাই আমরা এমন করে দিয়েছি যে, শিশুদের আমরা হাইপারঅ্যাক্টিভিটির দিকে সব সময় ধাবিত করছি। সুতরাং ঘুম, ডায়েট, স্ক্রিন টাইম, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা, একসঙ্গে মিলে খাওয়া-দাওয়া জরুরি। সবাই একসঙ্গে মিলে বসা, খাওয়া, টিভি দেখার অভ্যাস গড়তে হবে। কম্পিউটার ও গেমস আসক্তি যেন শিশুর মধ্যে না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

 

আরপি / আইএইচ-০২



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top