মাঙ্কিপক্সে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ
                                করোনাভাইরাস মহামারিতে এখনও স্বস্তিতে নেই বিশ্ববাসী। সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেকটাই কমে আসলেও কিছু কিছু দেশে তা এখনও আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। তবে এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স। বিশ্বের মোট ১২টি দেশে ইতোমধ্যেই ৯২ জনের দেহে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে।
ভাইরাসটির উৎপত্তি পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় হলেও বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও এর সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে বিশেষ সতর্কতাও জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত মোট ৯২ জনের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত হলেও সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছে ১১১ জন। আফ্রিকা ছাড়িয়ে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। আনুষ্ঠানিকভাবে নাম প্রকাশ না করলেও এখন পর্যন্ত দেশসমূহের তালিকায় রয়েছে- অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। তবে আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে সংস্থাটি।
মাঙ্কিপক্স কী ও কতটুকু মারাত্মক
মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের পেছনে রয়েছে মাঙ্কিপক্স নামের ভাইরাস। এটি স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। নতুন রোগটি ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট অঞ্চলের কাছাকাছি মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অংশে বেশি দেখা যাচ্ছে। মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের প্রধান দুটি ধরন- পশ্চিম (কঙ্গো) আফ্রিকান ও মধ্য আফ্রিকান।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের বেশি। এরমধ্যে বাচ্চাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তবে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতির তীব্রতা তুলনামূলক কম। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার এক শতাংশের মতো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। জ্বর কমলে শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। পরে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলায় ছড়ায় ফুসকুড়ি। সেই সঙ্গে আক্রান্তদের ত্বকে বসন্তের মতো দাগ দেখা দেয়। পাশাপাশি ফোস্কার মতো তৈরি হয়ে ফেটে গিয়ে চামড়া উঠতে থাকে।
তবে এর প্রাদুর্ভাব এখনও স্বল্প পরিসরেই রয়েছে জানিয়ে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভাইরাসটি খুব অল্পতেই সংক্রমিত করতে পারছে না বরং দীর্ঘক্ষণের সংস্পর্শ দরকার হচ্ছে। একই সঙ্গে এর সংক্রমণ নতুন নয়, ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আফ্রিকার ১০টি দেশে বিক্ষিপ্তভাবে এর সংক্রমণ ঘটতে দেখা গেছে।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তবে এটিই আফ্রিকার বাইরে ভাইরাসটির প্রথম সংক্রমণের ঘটনা। ওই সময় মোট ৮১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে এতে কারও প্রাণহানি ঘটেনি। ভাইরাসটিতে পূর্বে আক্রান্তদের প্রায় সবারই এর উৎপত্তিস্থলের দেশগুলোতে ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে বলেও খবর মিলেছে।
বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের ঝুঁকি ও প্রস্তুতি
বিশ্বে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণের শুরুতেই এ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে না পরে সে জন্য দেশের সব বন্দরে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা দেশের সকল বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলসহ সব বন্দর কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। সন্দেহভাজন কেউ আসলে যেন তাকে চিহ্নিত করা হয়। সেই সঙ্গে অতি দ্রুত তাকে সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কী ধরণের সতর্কতা নেওয়া উচিৎ জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সন্দেহভাজন রোগীদের চিহ্নিত করে হাসপাতালে পাঠাতে বলা হয়েছে। তবে এ ধরণের রোগীদের কীভাবে চিহ্নিত করবে সেটা স্পষ্টভাবে বলতে হবে। যাত্রীদের কোন প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করবে সেটাও ঠিক করতে হবে।’
বিএসএমএমইউ সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘এই ভাইরাসের ধরন অনুযায়ী আমার মতে এর স্ক্রিনিং পিসিআরের মাধ্যমে করতে হবে। এছাড়া মাঙ্কিপক্সের ব্যাপারে যতটা জানা গেছে, এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এর জন্য আমাদের মাস্ক পরতে হবে। করোনায় আমরা যেভাবে নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি, যেমন: মাস্ক পড়া, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করেছি, এটার ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। অর্থাৎ কোনো নতুন পদ্ধতি না, করোনার মতো করেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’
তবে মাঙ্কিপক্সের প্রতিরোধ ব্যবস্থা করোনার মতো হলেও এর চিকিৎসা করোনার মতো নয় বলে জানিয়েছেন বিএসএমএমইউর সবেক এই উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘এটি পক্স জাতীয় রোগ তাই এর চিকিৎসা পদ্ধতি করোনার মতো নয়। যদি দেশে সংক্রমণ দেখা দেয় তবে এর জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। এদের অন্য রোগীদের সঙ্গে মেলানো যাবে না।’
আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ
মাঙ্কিপক্সের বিষয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘মাঙ্কিপক্স নিয়ে আমাদের এতো প্যানিকড (আতঙ্ক) হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা ভাইরাসটির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সারাবিশ্ব থেকেই তথ্য উপাত্ত নেব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী যা ব্যবস্থা নেওয়ার সেটি করবো। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের সকল পর্যায়কে সতর্ক করা হয়েছে।’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ হার কেমন তা এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। আফ্রিকাসহ যেখান থেকে উৎপত্তি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশ এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। ১২টি দেশে ৯২ জনের শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মানে প্রতিটা দেশে ১০ জনেরও কম। তার মানে আমরা একে নিয়ে একদম হেলাফেলা করবো না, তবে আতঙ্কগ্রস্তও হবো না। আমাদের সতর্ক হতে হবে, পাশাপাশি প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা প্রস্তুত হওয়ার সময়টুকু পাচ্ছি।’
যৌনতার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কী?
মাঙ্কিপক্সের আতঙ্কের মধ্যেই এর সংক্রমণ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। মাঙ্কিপক্সে সমকামী ও উভয়কামীদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি দেখা দেওয়ায় যৌনতার সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিবিসি বাংলার এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘প্রথমবারের মতো এমন আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছে, যাদের সঙ্গে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার কোনো যোগাযোগ নেই। তারা কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হচ্ছে এটি যৌন সংসর্গের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। বেশিরভাগ আক্রান্তের যৌনাঙ্গ এবং এর আশেপাশে ঘা এর মতো পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া আক্রান্তদের অনেকেই সমকামী ও উভয়কামী কম বয়স্ক পুরুষ।’
তবে কিছু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ভাইরোলজিস্টরা বলছেন যে, সমকামী পুরুষদের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের সম্পর্ক উল্লেখ করে প্রচারণা চালানো উচিত নয়। এটি অনেকটা ৪০ বছর আগে এইডস নিয়ে চালানো প্রচারণার মতোই। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসক ড. বোঝুমা কাবিসেন টাইটানজি বলেন, ‘মাঙ্কিপক্স সমকামী রোগ নয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইল অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যৌনতার সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটি নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। এখন পর্যন্ত সমকামী ও উভয়কামীদের মধ্যে এর সংক্রমণ বেশি পাওয়া গেছে। তবে এটার সঙ্গে সমকামিতা বা যৌনতার কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। হয়তো এটা কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে। এটি নিয়ে আমাদের বলার সুযোগ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশ এ নিয়ে কাজ করছে। আশা করা যায় দ্রুতই তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে। আমাদের এ নিয়ে সজাগ থাকতে হবে, যেন কোনো গুজব ছড়িয়ে না পড়ে।’
সূত্র: ঢাকা মেইল
আরপি/এসআর-০৪
বিষয়: ডব্লিউএইচও মাঙ্কিপক্স

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: