নওগাঁর
মহাদেবপুরে যুবলীগ নেতা মাসুদের গ্রেফতার নিয়ে প্রতিবাদের ঝড়

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদকে মহাদেবপুর থানা পুলিশের সহযোগিতায় নওগাঁ সদর থানা পুলিশ গত ১৪ এপ্রিল বিকেলে সদর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার গোপাল শাহা মার্কেট থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
কেন তাকে গ্রেফতার করা হলো এনিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেউ বলছেন ঠিক হয়েছে। আবার কেউ বলছেন তিনি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছেন। তার গ্রেফতার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অবিলম্বে তার মুক্তি চেয়ে এলাকায় পোষ্টারিংও করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ সদর থানায় দায়ের করা একটি মামলায় পুলিশ তাকে আটক করে পরদিন নওগাঁ কোর্টে চালান দেয়। করোনা ভাইরাসের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তার জামিন শুনানী করা যাচ্ছেনা। ফলে তখন থেকে নওগাঁ জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন তিনি।
নওগাঁ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সোহরাওয়ার্দী হোসেন জানান, মাসুদের বিরুদ্ধে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক রেজাউল করিম বাদী হয়ে নওগাঁ সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলা নং ১৪, তাং ১৩/৪/২০২০, ধারা ৪০৬/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪২০ দন্ডবিধি। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। মামলায় মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি মহাদেবপুর বালুমহালের দরপত্র দাখিলের সময় তাতে ঘষামাজা করেছেন।পত্নীতলা উপজেলার বালুমহালের জন্য নির্দিষ্ট দরপত্র কিনে তাতে “পত্নীতলা” শব্দটি ইরেজ করে সেখানে “মহাদেবপুর” শব্দ লিখে দাখিল করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা থেকে মহাদেবপুর, পত্নীতলা ও মান্দা উপজেলার বালুমহাল বাংলা ১৪২৭ সনের জন্য ইজারা দেয়ার দরপত্র আহ্বান করা হয় গত ৩ মার্চ। সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন দর ছিল ১ কোটি ৪২ লাখ ৫২ হাজার ৭৬৯ টাকা।
প্রথম বারে দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল ২৩ মার্চ। ওই দিন বিকেলে জেলা প্রশাসকের অফিস কক্ষে জেলা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে দরপত্র বাক্স খুলে দেখা যায় মহাদেবপুর বালুমহালের জন্য মোট ৩ টি দরপত্র দাখিল করা হয়েছে।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন এমআরজে এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী কুঞ্জবন গ্রামের জসীম উদ্দিনের ছেলে মো. মাসুদুর রহমান ১ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার ৫৫১ টাকা। দ্বিতীয় মেসার্স হ্যাপী ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী মহাদেবপুর ব্রীজ রোডের মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন ১ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় মেসার্স তরফদার ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী শালগ্রাম গ্রামের মো. এরশাদ আলীর ছেলে মো: সাঈদ হাসান।
ওই দিন ৩ টি দরপত্র যাচাই বাছাই শেষে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে মাসুদের নামে ১৪২৭ সনের জন্য মহাদেবপুর উপজেলার বালুমহাল ইজারা দেয়ার মৌখিক ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু পরদিন দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতা জেলা প্রশাসকের নিকট অভিযোগ করেন যে, মাসুদের দাখিল করা দরপত্রটি স্ক্যানিং, ভূয়া, জাল ও টেম্পারিং করা।
তারা দরপত্রটি বাতিল করে তাদের নামে ইজারা দেয়ার দাবী জানান। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ডেকে পুণরায় দরপত্রটি যাচাই বাছাই করা হয় এবং তা ঘষামাজা, টেম্পারিং করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য ২৫ মার্চ ঢাকার সিআইডি বিভাগের অতিরিক্ত আইজিপির নিকট পাঠানো হয়।
৬ এপ্রিল সেখান থেকে রিপোর্ট আসে যে, “মহাদেবপুর” শব্দটি লেখার জায়গায় অন্য কোন শব্দ ছিল, যা ঘষামাজা করে টেম্পারিং করা হয়েছে। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয় যে, মাসুদ মহাদেবপুর উপজেলার আত্রাই নদীর বালুমহালের জন্য একটি দরপত্র কেনেন। কিন্তু তিনি তা সমঝোতা করে অভিযোগকারীদের কাছে হস্তান্তর করেন।
পরে পত্নীতলা উপজেলার বালুমহালের জন্য কেনা দরপত্রে “পত্নীতলা” শব্দটি ইরেজ করে “মহাদেবপুর” লিখে দাখিল করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি সরকারের সাথে প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ ও জালিয়াতি করেছেন। এই অভিযোগে মাসুদের দরপত্র বাতিল করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা মোয়াজ্জেম হোসেনের নামে মহাদেবপুর বালুমহাল ইজারা দেয়া হয়।
এছাড়া মাসুদের দাখিল করা জামানতের প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিডি বাজেয়াপ্ত করা হয়। জানতে চাইলে আলহাজ্ব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বিধি অনুযায়ীই প্রশাসন তার নামে বালুমহাল ইজারা দিয়েছেন। মাসুদের মত একজন রাজনীতিকের এ ধরনের জালিয়াতি করা মোটেও ঠিক হয়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মাসুদের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ সম্মেলনে দাবী করেন যে, মাসুদ কোন জালিয়াতি করেননি। বরং ঘষামাজা, টেম্পারিংয়ের সাথে জেলা প্রশাসনের কেউ জড়িত আছে কিনা তা ক্ষতিয়ে দেখা উচিৎ। তিনি বলেন, দরপত্র একটি গোপনীয় বিষয়।
যাচাই বাছাইয়ের পর তা অন্য দরদাতাদের কোনক্রমেই পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাছাইয়ের পরদিন তারা কি দেখে জানলেন যে, তা টেম্পারিং করা হয়েছে? তিনি আরও বলেন, মাসুদ জালিয়াতি করে থাকলেও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাকে কোন কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়নি।
উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারলে প্রশাসন তার লাইসেন্স বাতিলসহ নানা পদক্ষেপ নিতে পারতো। তিনি দাবী করেন যে, দরপত্র দাখিলের আগে (অবৈধ) সমঝোতা হয়েছে এটা জানার পরও প্রশাসন সবগুলো দরপত্র বাতিল করে পূণ: দরপত্র আহ্বান না করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতার নামে ইজারা দিয়েছেন।
এতে সরকার প্রায় ২০ লাখ টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন যে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেয়ার জন্যই তরিঘড়ি করে মামলা দায়ের করে পরদিন বছরের প্রথম দিন মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়।
আরপি / এমবি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: