রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


করোনাকালেও অপ্রতিরোধ্য রাজশাহী কলেজ


প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ১৫:৫৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:১৬

ফাইল ছবি

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। সেই সময়েও স্বাস্থ্য, খাদ্য, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির নানামুখী সঙ্কট মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এই অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের মতই অপ্রতিরোধ্য দেশসেরা রাজশাহী কলেজ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২৮টি সূচকে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা চারবার এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ১৪টি সূচকে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চারবার সেরার মুকুট পরেছে রাজশাহী কলেজ। পেয়েছে মডেল কলেজের খেতাব। পরবর্তী র‌্যাংকিং ঘোষণাতেও প্রথম হওয়ার প্রত্যাশায় রয়েছে কলেজটি। এত এত অর্জনের পরেও থেমে নেই; করোনা সঙ্কটেও দুর্বার গতিতে নিজেদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে চলেছে আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

করোনায় যখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থবির, তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পূর্বেই ভার্চুয়ালি ক্লাস নেয়া শুরু করেছে রাজশাহী কলেজ। অনলাইন ক্লাসের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরী করা হয়েছে ৫টি স্টুডিও। এর বাইরে বিভিন্ন বিভাগ ও শিক্ষকরা স্টুডিও নির্মাণ এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করছেন। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত কলেজের একাদশ শ্রেণীর ৮৯৫টি, দ্বাদশ শ্রেণির ৫৬৬টি, স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ৫২৫৯টি ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির ১৭৪৯টি ক্লাস গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বমোট ৮ হাজার ৪৬৯টি ক্লাস নেয়া হয়েছে; যা একটি মাইলফলকও বটে। 

অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হয়তো রাজশাহী কলেজের মত কিছু ভালো কার্যক্রম ও ফ্যাসিলিটিজ রয়েছে। তবে একটি জায়গায় অনন্য এই প্রতিষ্ঠান। স্টুডেন্ট সেন্টার্ড লার্নিং মেথড ক্লাসরুম; পুরো বাংলাদেশে আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ক্লাসরুম নেই বলে দাবি করেন অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। 

স্টুডেন্ট সেন্টার্ড লার্নিং মেথড ক্লাসরুম হলো এমন একটি পাঠদান পদ্ধতি যেখানে বেঞ্চ ব্যবস্থা তুলে দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকের মত গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্লাসে অংশ নিতে পারেন শিক্ষার্থীরা। এই পদ্ধতিতে পাঠদানের ফলে শিক্ষার্থীদের বেশি ইন্ট্যারেক্টিভ করা যায়। প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে এরকম ৩৬টি ক্লাসরুম তৈরী করা হয়েছে। যা ইতোমধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে ইনোভেশন পুরস্কার লাভ করেছে। জাতীয় পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হতে যাচ্ছে। 

শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানার্জন সহজ, সাবলীল ও অংশগ্রহণমূলক করতেই স্টুডেন্ট সেন্টার্ড লার্নিং ক্লাসরুম। এই ক্লাসরুমের ভাবনা মাথায় আসে অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমানের। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ‘ইনোভেশন ইন এডুকেশন’ শীর্ষক শিক্ষাসফরে ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও নরওয়ে ভ্রমণ করেন তিনি। ফিনল্যান্ডের অত্যাধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কিভাবে রাজশাহী কলেজে বাস্তবায়ন করা যায়; তার এমন ভাবনার প্রতিফলন রাজশাহী কলেজের এই আমূল পরিবর্তন।

ইনোভেশন সফরে উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়াসরুম দেখে নিজ প্রতিষ্ঠানে তা বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন অধ্যক্ষ। এরই প্রেক্ষিতে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে অভাবনীয় সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত ২১৯টি ওয়াশরুম। প্রতিটি টয়লেটে স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও ব্রেস্টফিডিং ব্যবস্থাসহ নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক কমনরুম।

গ্রীণ, ক্লিন ও ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস রাজশাহী কলেজের। শুধু দেশে নয়, উন্নত দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়েও সুন্দর ক্যাম্পাস। কলেজের নিজস্ব অর্থায়নে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ সকল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। করোনাকালেও এর সৌন্দর্য ম্লান হয়নি।

করোনাকালে রোপণ করা হয়েছে ৬ শতাধিক চারাগাছ। এছাড়াও বছরজুড়ে পালন করা হয়েছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। লাগানো হয়েছে ১ হাজার প্রজাতির গাছ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে রোপণ করা হয়েছে ১০০টি অত্যন্ত মূল্যবান ও বিরল প্রজাতির গাছ। এছাড়াও ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা হয়েছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্ণার। ফলে সবুজে ঢাকা রাজশাহী কলেজ শুভ্রতা ছড়াচ্ছে এই করোনাকালেও।

করোনায় মানবিক কার্যক্রমেও পিছিয়ে নেই কলেজটি। এই মহামারির সময়ে কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে প্রতিষ্ঠানটি বিতরণ করেছে ৮ লাখ টাকা। এছাড়াও ৮ হাজার ৫০০ কেজি চাল, ১ হাজার ৫০০ কেজি ডাল, ২ হাজার কেজি আলু, ১২ হাজার ৭০০ বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছে।

মানবিক কার্যক্রম, সৌন্দবর্ধন, শিক্ষার্থীদের দক্ষতাবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এরকম কোন কার্যক্রমেই থেমে নেই রাজশাহী কলেজ। দিন গড়ানোর সাথে কলেজটির আধুনিকায়ন ও সৃজনশীল কার্যক্রম বিস্তৃত হচ্ছে।

কলেজের রয়েছে ৬টি সমৃদ্ধ আইসিটি ল্যাব। এগুলোতে রয়েছে ১৮৭টি কম্পিউটার। এছাড়াও লাইব্রেরিতে ১০টি, প্রতিটি বিভাগের সেমিনারে ২টি করে ৪৬টি ও ২৪১ জন শিক্ষকের প্রত্যেককে ১টি করে ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। কলেজের রসায়ন ও ভূগোল বিভাগের জন্য রয়েছে আলাদা কম্পিউটার ল্যাব। কলেজের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয় ২১ দিনব্যাপী আইসিটি কোর্স। ইতোমধ্যে এই কোর্সের অধীনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৫০ জন শিক্ষার্থীকে।

মিরর ডিবেটিং ক্লাব, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি, নাট্য সংসদ, সঙ্গীত চর্চাকেন্দ্র, বিএনসিসি, রোভার, রেঞ্জার, বিজনেস ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লারের মত চল্লিশোর্ধ সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংগঠন রয়েছে কলেজের। সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, কমিউনিকেশন ও লিডারশীপ এবং সফ্ট স্কিল ডেভেলপমেন্টে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। করোনা মহামারীর মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক অনলাইন ইভেন্ট, আলোচনা, মতবিনিময়, সেমিনার ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এসকল সংগঠন ও কলেজের ব্যানারে। যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অংশগ্রহণ করেছেন। করোনায় শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে দৃঢ় রাখতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং। শিক্ষকদের আইসিটি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ধারাবাহিক কর্মশালা।

কলেজে জ্ঞানার্জনের জন্য রয়েছে সুবিশাল গ্রন্থাগার। যেখানে রয়েছে পুরোনো দিনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছাড়াও নিত্যনতুন প্রয়োজনীয় বইসমূহ। করোনার পূর্বে মুক্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিদিনই সেখানে ভীড় জমাতেন শিক্ষার্থীরা।

অবকাঠামো উন্নয়নে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে রাজশাহী কলেজ। সরকারি বরাদ্দের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজস্ব অর্থায়নেও যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে সাজানো যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজশাহী কলেজ। নিজস্ব অর্থায়নে কলেজের বিভিন্ন ভবন সংস্কার করা হয়েছে।

কলেজের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নামে ৭টি ভবন নিয়ে মুসলিম ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে চলছে ব্যাপক সংস্কার। পরিচ্ছন্ন রাখতে ছাত্রাবাসে স্থাপন করা হয়েছে দেড় শতাধিক ডাস্টবিন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত হচ্ছে ৫ তলা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্রাবাস’।

রাজশাহী কলেজের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে লালরঙ্গা ভবন। ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর নির্দশন কলেজের প্রশাসন ভবন, ফুলার ভবন, হাজী মোহম্মদ মহসিন ভবনসহ কয়েকটি ভবন। এই ভবনগুলোর লাল রঙ যেন একটি ব্র্যান্ড। এসকল ভবনের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে প্রতিটি ভবনকে সেই রঙে রাঙানো হয়েছে। লালরঙা ভবন রাজশাহী কলেজের একটা পরিচিত।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডি পর্যন্ত সকল ইতিহাস স্থান পেয়েছে ক্যাম্পাসে নির্মিত টেরাকোটায়। করোনাকালে সাড়ে ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কলাভবনের সামনে ৩২ ফুট দীর্ঘ এই টেরাকোটা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে খোদাই করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। প্রশাসন ভবনের সামনে ‘রাজশাহীর চোখ’ শীর্ষক স্থাপনাতে জায়গা পেয়েছে বিভাগের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ। যা শিক্ষার্থীদের ইতিহাসচর্চাকে সমৃদ্ধ করবে। 

প্রশাসন ভবনের পাশে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ম্যুরাল দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ। ১৭ সেপ্টেম্বরে এর ফলক উন্মোচন করেন রাজশাহী সিটি কপোরেশনের মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন। ২৫ ফুট দীর্ঘ ও ২২ ফুট প্রস্থ এই ম্যুরালটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ৫৫ টাকা। এছাড়াও হাজার হাজার বই নিয়ে কলেজের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু কর্ণার।

কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা। বিভিন্ন ভবন ও ক্লাসরুম মিলিয়ে শতাধিক উন্নতমানের সংক্রিয় এসকল ওয়াটার ফিল্টার স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো থেকে সরাসরি পানি পান করতে পারেন শিক্ষার্থীরা। ব্যাকটেরিয়া রোধে সাড়ে ১০ লাখ টাকায় স্থাপিত ফিল্টারগুলোর মেশিন প্রতি তিনমাস পর পরিবর্তন করা হয়।

অসহায় ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পথ সুগম করেছে রাজশাহী কলেজ। ১৫১ জন শিক্ষার্থীকে প্রদান করা হয় মাসিক বৃত্তি। এসকল শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২০০ টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। এছাড়াও বৃত্তি প্রদান করা হয় ১৩ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীকে।

প্রতি বছর কলেজের দুইটি গবেষণা জার্নাল বের হয়। গবেষণাধর্মী ‘জার্নাল অব সোস্যাল সায়েন্স’ এবং ‘বাংলা সাহিত্যিকী’। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগ ও সহশিক্ষা সংগঠন থেকে বের হয় নিয়মিত প্রকাশনা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে গবেষণাধর্মী জার্নাল ‘মুজিব সংখ্যা’ বের করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বুনন’। এর বাইরেও কলেজের বাৎসরিক ম্যাগাজিন, ক্যালেন্ডার, ডায়েরী ইত্যাদি তো রয়েছেই।

কলেজের রয়েছে নিজস্ব অনলাইন সার্ভার। এর মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে ভর্তি, ডাটাবেজ তৈরী, অনলাইনে ফি জমা দেয়া ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে ভর্তির জন্য বা টাকা জমা দেয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড়াতে হয় না। এছাড়াও কলেজের বিভিন্ন সংবাদ ও সংবাদযোগ্য তথ্য প্রচারের জন্য চালু হয়েছে কলেজের নিজস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘রাজশাহী কলেজ বার্তা’। এছাড়াও রয়েছে কলেজ কর্তৃক পরিচালিত অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও ফেসবুক গ্রুপ। প্রত্যেকটি বিভাগের রয়েছে ফেসবুক পেজ।

কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন তত্ত্বাবধানকারী ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক জানান, কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৩টি বাস। প্রতিমাসে গড়ে এগুলোর জন্য ব্যয় হয় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা।

কলেজের সুরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে ৪ শতাধিক আইপিএ ক্যামেরা। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোনায় নজরদারি রাখা হয়। মনিটরসহ এর জন্য ব্যয় হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা।

প্রার্থনার জন্য রয়েছে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন মসজিদ ও মন্দির। কলেজের পুকুরে রয়েছে বিরল প্রজাতির শাপলা ও পদ্মফুল। রয়েছে বিভিন্ন পশুপাখির প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো ক্যাম্পাস। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের প্রতিটি বৃক্ষে বৈজ্ঞানিক নামসহ নামফলক লাগানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শিক্ষায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে মনীষীদের উক্তি সম্বলিত বোর্ড লাগানো হয়েছে।

সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও অভাবনীয় সাফল্য রয়েছে এই কলেজের শিক্ষার্থীদের। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকসংখ্যকহারে জায়গা করে নিচ্ছে এই কলেজের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। 

দেশসেরা কলেজের কারিগর অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান বলেন, যেকোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যিনি প্রধান থাকেন তার উপর নির্ভর করে কিভাবে প্রতিষ্ঠানটি কেমন হবে? এজন্য প্রধানের মিশন, ভিশন ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। আমরা বলি, হাফ প্ল্যান ওয়েল ডান। আমার মেয়াদে আমি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম। আমরা শিক্ষার ক্ষেত্রে এসডিজি-৪ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য আমরা চেয়েছি, একটি মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মানসম্মত শিক্ষার্থী সৃষ্টি করতে। এ লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের সকল সুবিধা ব্যবহার করে আমরা মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করছি। ২০১১ সাল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি মনে করি, রাজশাহী কলেজ অন্যান্য শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের জন্য আদর্শ। শিক্ষার্থী, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পিওর ড্রিংকিং ওয়াটার পদ্ধতি কিংবা স্যানিটেশন সবগুলো কার্যক্রমই অনুকরণীয়। একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানের যতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার; তার সবই এখানে রয়েছে। কেউ যদি রাজশাহী কলেজ পরিদর্শন করেন; তাহলে তিনি ভাববেন, এটা কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান দেখতে এসেছেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় রাজশাহী কলেজে এসে এমনটাই বলেছেন।

রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত কলেজটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। ছোট্ট পরিসরে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে প্রায় ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদানের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ ও দেশের শিক্ষাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

১৮৭৩ সালে দুবলহাটীর রাজা হরলাল রায় বাহাদুরের আর্থিক সহায়তায় স্থাপিত হয় রাজশাহী কলেজ। ১৮৭৩ সালে এপ্রিলের ১ তারিখে রাজশাহী জেলা স্কুলে (বর্তমান কলেজিয়েট স্কুল) এফএ (ফার্স্ট আর্টস) শ্রেণী চালুর মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হয়।
কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন হরগোবিন্দ সেন। ১৮৭৭ সালের অক্টোবর মাসে স্নাতক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন) নির্মাণ করা হয় ১৮৮৪ সালে। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার রাণী হেমন্তকুমারী তার নামে একটি হোস্টেল এবং কলেজের অধীনে মহারাণী হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতকোত্তর কলেজ হিসেবে ১৮৮১ সালে এমএ কোর্স এবং ১৮৮৩ সালে আইন কোর্স পরিচালনার অনুমতি লাভ করে রাজশাহী কলেজ। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো। দীর্ঘ পথযাত্রায় অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি এ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এফ টি ডাউডিং, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. এনামুল হক, অধ্যাপক সুনীতি কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৬ সালে এ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক কোর্সে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১০ সালে তা পুনরায় চালু করা হয়। বর্তমানে কলেজে ২৪টি বিভাগে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর, ডিগ্রি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়।

অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওড়িশার শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে পড়তে আসতেন। এই কলেজে শিক্ষা লাভ করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান। এছাড়াও এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য স্যার যদুনাথ সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া, কাজী মোতাহার হোসেন, কান্তকবি রজনীকান্ত সেন, কাজী আব্দুল মান্নান-সহ আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। 

 

 

আরপি/এসআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top