রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


গৌরবের সার্ধশতবর্ষে রাজশাহী কলেজ


প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২২ ০৯:৪৭

আপডেট:
১ এপ্রিল ২০২২ ১০:০১

ছবি: রাজশাহী কলেজ

উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ। ১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া কলেজটি পদার্পণ করেছে ১৫০ বছরে। ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা কলেজটি ব্রিটিশ আমল থেকেই দখল করে রেখেছে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের আসন। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখনও স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহী কলেজ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে টানা তিনবারের সেরা কলেজের স্বীকৃতিও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের।

প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত কলেজটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা রাজশাহী কলেজ পরিণত হয়েছে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর উত্তরবঙ্গ তথা দেশের শিক্ষাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলা প্রতিষ্ঠানটি।

ছবি: মহসিন ভবন

আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ জমিদার রাজার হাতে জন্ম হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। এরপর অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্র এসেছেন জ্ঞানার্জনে, নিজেকে গড়েছেন, আবার কালের পরিক্রমায় আলো বিলিয়ে চলে গেছেন পরপারে। সেই আলোতে আজও পথ চলে নতুন প্রজন্ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৮টি সূচকে টানা তিনবার এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৪টি সূচকে প্রতিবারই সেরার মুকুট অর্জন করে রাজশাহী কলেজ। মডেল কলেজের স্বীকৃতিও রয়েছে রাজশাহী কলেজের ঝুঁলিতেই।

ছবি: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার 

জানা যায়, প্রাচীন বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল ও রাজশাহী জেলা স্কুলের (বর্তমান কলেজিয়েট স্কুল) হাত ধরেই পথচলা শুরু করে রাজশাহী কলেজ। ১৮৭৩ সালে দুবলহাটীর রাজা হরলাল রায় বাহাদুরের আর্থিক সহায়তায় স্থাপিত হয় ভবন। ১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল রাজশাহী জেলা স্কুলে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) শ্রেণী চালুর মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় প্রথম গ্রেডের মর্যাদা পায় কলেজটি। রাজশাহী কলেজ নামকরণ হয় সে সময়েই। একই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর উত্তরবঙ্গের প্রথম কলেজ হিসেবে রাজশাহী কলেজেই চালু হয় বিএ কোর্স।

১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স চালু হয় কলেজটিতে। স্নাতক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি মিলে ১৮৭৭ সালের অক্টোবরে। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করা হয় কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন)। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার রাণী হেমন্তকুমারী তার নামে একটি হোস্টেল এবং কলেজের অধীনে মহারাণী হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।

ছবি: কলা ভবন

১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রমও। তবে শিক্ষার্থী নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম।

এ কলেজে পড়াশোনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু, উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি স্যার যদুনাথ সরকার, বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃত ও অন্যতম সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া, শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, জাতীয় চার নেতার অন্যতম এএইচএম কামরুজ্জামানের মতো বরেণ্য ব্যক্তিরা।

ছবি: ফুলার ভবন

তৎকালীন রাজশাহী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। সুদীর্ঘ পথচলায় অসংখ্য প্রথিতযশা ব্যক্তি শিক্ষকতা করেছেন কলেজটিতে। তাঁদের মধ্যে এফ টি ডাউডিং, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. এনামুল হক, অধ্যাপক সুনীতি কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কথিত আছে, অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওড়িশার শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে পড়তে আসতেন। চীনা কারিগর মিস্ত্রিদের হস্তশিল্পের সমন্বয়ে ব্রিটিশশৈলীতে কাঠের সানশেড দিয়ে নির্মিত এই কলেজের প্রশাসন ভবনটি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে সগৌরবে। কলেজের এই সুরম্য স্থাপত্যশৈলী এখনো সগৌরবে কলেজটির ঐতিহাসিক পরিচয় ঘোষণা করে, যা যে কোনো পথচারীর মনোযোগ কাড়ে নীরবে।

হাজি মুহাম্মদ মহসীন ভবন, ফুলার ভবন, প্রশাসন ভবনের মত লালরঙ্গা ভবনগুলো এখনও প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন। যে ভবনগুলো আজও সেই আমলের রাজকীয় স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয় বর্তমান প্রজন্মকে। এছাড়া বেশ কয়েকটি নতুন ভবনও রয়েছে। সেগুলোতেও করা হয়েছে প্রাচীন ভবনগুলোর মত লাল রং। ফলে রাজশাহী কলেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে লালরঙা ভবন।

রাজশাহী কলেজ মানেই পরিপাটি ক্যাম্পাস। পড়ালেখা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, আড্ডা, গল্প কিংবা গান সব কিছুই চলে সমান তালে। শুধু জ্ঞানার্জনই নয়, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুথান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বাঙালীর সকল গৌরবোজ্জল ইতিহাসে আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে রয়েছে রাজশাহী কলেজের নাম।

এই কলেজেই রয়েছে ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী সব শহীদের স্মরণে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের উপর গুলি বর্ষণের খবর ট্রেনে করে রাজশাহী আসে। তাৎক্ষনিক রাজশাহী কলেজ ও আশপাশের প্রগতিশীল চিন্তাধারার শিক্ষার্থীরা সমবেত হয় কলেজ ছাত্রাবাসে। সিদ্ধান্ত হয় ইট-মাটি দিয়ে রাতেই শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ তৈরির। সে মোতাবেক তৈরি হলেও পরদিন সকালে সেসব গুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি জান্তা বাহিনী।

সময়ের সাথে নিজেকে আধুনিকতায় সাজিয়েছে রাজশাহী কলেজ। কলেজের প্রতিটি বিভাগে চালু করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষকদের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ। গবেষণা আর তথ্য বিনিময়ে বহির্বিশ্বের সাথে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগে দেয়া হয়েছে ওয়াই-ফাই সেবা।

কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রেণিকক্ষ, প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ ফটকগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে সিসি ক্যামেরায়। প্রায় তিন লাখ বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে রয়েছে এক বিশাল গ্রন্থাগার। যেখানে রয়েছে পুরোনো দিনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছাড়াও নিত্যনতুন প্রয়োজনীয় বইসমূহ। মুক্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিদিনই সেখানে ভীড় জমান শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে পঞ্চাশোর্ধ সহশিক্ষা সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ), রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, বিতর্ক ক্লাব, রেঞ্জার গাইড, বিজ্ঞান ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, সংগীত একাডেমী, নৃত্য চর্চা কেন্দ্র, বাঁধন, বরেন্দ্র থিয়েটার, অন্বেষণ, নাট্য সংসদ, আবৃত্তি পরিষদ, ফটোগ্রাফি ক্লাব, রোটার‌্যাক্ট ক্লাব, এথিক্স ক্লাব, প্রেজেন্টেশান ক্লাব, ক্রিয়েটিভ ক্লাব, ইনোভেশন ক্লাব, রেড ক্রিসেন্টসহ প্রতিটি বিভাগে রয়েছে একটি করে স্বতন্ত্র ক্লাব।

‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ চিরন্তন সত্যকে সামনে রেখে রাজশাহী কলেজে রয়েছে একটি ব্যায়ামাগার। এখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শারীরিক ও মানসিক গঠনে ব্যায়ামসহ নানা অনুশীলন করে থাকেন। নামাজের জন্য রয়েছে দ্বিতল মসজিদ। নগরীর বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।

পাঁচশ’র বেশি কম্পিউটার সংবলিত ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব’ রাজশাহী কলেজেই। ল্যাবে কলেজের সকল শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ছাড়াও আউটসোর্সিং ও বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগেও আলাদা ল্যাব রয়েছে।

প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে জানতে চাইলে রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আনোয়ার পূর্ণা বলেন, রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে গৌরবের ১৫০ বছর উদযাপন করতে পারাটা নিঃসন্দেহে অনেক আনন্দের। রাজশাহী কলেজ একটি আবেগের নাম। রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে নিজেকে উপস্থাপনের অসংখ্য সুযোগ পেয়েছি। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য কলেজ প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, সবুজের মাঝে লাল-সাদা দালানের মহিমা ছড়িয়ে যাক বহুগুণে।

রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, ১৮৭৩ সালে কলেজিয়েটের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হওয়া কলেজটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় উপমহাদেশের অসংখ্য জ্ঞানীগুণী জ্ঞানার্জন করে পুরো বিশ্বে সেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন।

সরকারের সুনজর, অভিভাবকদের মানসিকতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরলস পরিশ্রম, রাজনৈতিক ও গণমান্য ব্যক্তিবর্গের সর্বোচ্চ সহযোগীতায় সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে কলেজটি। দক্ষ ও মেধাবী জাতি গঠনে সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সোনার বাংলা গড়তে রাজশাহী কলেজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেও মন্তব্য করেন অধ্যক্ষ।

তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠা দিবসে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হওয়ায় কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বেলা সাড়ে ১১টায় বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠা দিবসের উদ্বোধন ও কেক কাটা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আতশবাজি উড়িয়ে দিবসটি পালন করা হবে।



 

আরপি/এসআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top