রাজশাহী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


আত্মহত্যা: সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৪৬

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৩৪

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহননকারী শিক্ষার্থী ইসতিয়াক

 

দেশে করোনা সংক্রমণের পর দীর্ঘ সময় ধরে একেরপর এক চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের বেড়াজালে জীবন নামক মায়জালকে কতটা প্রভাবিত করেছে? ব্যক্তিভেদে তার গভীরতা কেমন? এর প্রভাবের পরিনতিটা কি? ব্যক্তিভেদে এর পরিনতিটা যেমন ভিন্ন তেমননি উত্তরটাও ভিন্ন হওয়ার কথা। কারণ অন্যের শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির গল্প শুনে তা কিছুটা আঁচ করা সম্ভব।

অনুভব করা গেলেও তা ক্ষণস্থায়ী। এই আঁচের ধাঁচটা আবার ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। আর এই ধাঁচের ভঙ্গুরতার কারণে আত্মহত্যা নামক যে সামাজিক ব্যধির শঙ্কা বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ করছিলেন তা দৃশ্যমান। তবে আশঙ্কাতীতভাবেই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী ও অর্ধ-শিক্ষিত ব্যক্তিরা জীবন সমস্যার সমাধান হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। উল্লেখ্য, এখানে অর্ধ শিক্ষিত শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে অনেকেই ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। তবে আমি মনে করি কোন প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি কখনোই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।


যাইহোক, আত্মহত্যা কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু কাম্য নয়; বললেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আত্মহত্যার দায়ভার কি শুধুই ব্যক্তির নিজের। নাকি পারিপার্শ্বিকতা, তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও দায় রয়েছে। সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুশিক্ষিত ব্যক্তিরা এই দায় অকপটেই শিকার করবেন জানি। কিন্তু দায় শিকার করে সমাধানের পথে আপনারা কতটুকু অগ্রসায়মান। তা রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইসতিয়াক মাহমুদের আত্মহত্যার পূর্বের স্ট্যাটাস দেখে আঁচ করা যায়।


ইসতিয়াক লিখেছেন, লেখাটা যখন আপনারা পড়বেন, তখন আমি আপনাদের ছেড়ে অনেক দূরের, না ফেরার দেশের যাত্রী। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আমাকে ভালোবাসেন। হয়তো কোন কারণ ছাড়াই বাসতেন। খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম না হয়তো কারোর কাছে। তবে ছিলাম তো? আবার অনেকেই আছেন যারা আমাকে ঘৃণা করতেন। কেন করতেন??! আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন আমাকে মাথায় তুলে আবার ছুড়ে ফেলেও দিয়েছেন। তাতেও আমার কারোর বিরুদ্ধে আর কোনই অভিযোগ নেই। আমার সমস্যা শুধু আমার নিজেকে নিয়ে। নিজের মনটাকে আর বুঝিয়ে রাখতে পারছিলাম না। মনের সাথে যুদ্ধ করে আমি বার বার হেরে যাচ্ছিলাম। রোজই মৃত্যু আমাকে তাড়া করছিলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। সেই কবে থেকে। গত কিছু দিন আমি অসহ্য মানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করেও বাঁচতে চেয়েছি। ভরপুর বেঁচে থাকার স্বাদ ছিলো। সব মানুষের কাছে বেঁচে থাকার আর্জি জানিয়েছি। আমি বার বার বাঁচতে চেয়েছিলাম।


এখান থেকে স্পষ্ট যে, মানসিক যন্ত্রণার কারণ থেকে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। একজন প্রিয় মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা যন্ত্রণা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছিলো। তার কথায় বোঝা যায় সে অনেকবারই আত্মহত্যার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। আবার সে যে আত্মহত্যা করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটা বিভিন্নভাবে তার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোকে বুঝিয়েছে। কিন্তু সেটাকে গুরুত্ববহনকারী ইঙ্গিত হিসেবে কারও মনেই হয় নি। কারণ বর্তমান কালচারে এটা তেমন অস্বাভাবিক নয়। আর এই অস্বাভাবিকতাকে স্বাভাবিক ভাবতে না পেরেই আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।

 

শুধু এই ঘটনায় নয়। পুরো জাতিকে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে চিত্র নায়ক রিয়াজের শশুরের আত্মহত্যার ঘটনা। যেখানে তিনি তার শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত সন্তানদের বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বহীন আচরণের চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আলোচিত এই ঘটনার বাইরেও প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছেই।

 

সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই এমন বহু আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। সমাজজুড়ে মানবিক অবক্ষয়ের কারণে কেউ কথিত প্রেম কালচারের শিকারে পরিণত হচ্ছে। কেউ কথিত আধুনিকতার শিকারে। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সামাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়হীন আচরণের নেতিবাচক প্রভাব করোনাকালে স্পষ্ট হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থাগুলোর শিক্ষা যে নিজের প্রতিও মমত্ববোধ, ভালোবাসাবোধ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ তা এমন ঘটনায় স্পষ্ট।


এখন প্রশ্ন হলো- করোনার ক্লান্তিলগ্নে যে ডি মেরিটগুলোকে প্রকাশিত হচ্ছে এবং যা ক্রমবর্ধমান, তা রুখতে সমাজপতি, সুশীল সমাজ ও কথিত আধুনিকতাবাদীরা কি পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন? নাকি গড্ডলিকায় ভাসতে থাকবে এমন শত তাজা প্রাণ। মুক্ত সাংস্কৃতির চর্চাঙ্গণের নামে নিজের রশিতে ঝুঁলবে প্রাণ।#

                                                          লেখক: সাংবাদিক মাহাবুল ইসলাম 

                                  

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top