রাজশাহী শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১


পুলিশের অভিযোগপত্র:গেস্টরুমে সভা করে আবরারকে হত্যার সিদ্ধান্ত


প্রকাশিত:
১৬ নভেম্বর ২০১৯ ১৮:২৫

আপডেট:
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:১৯

ছবি: প্রতীকী

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বী হত্যা মামলায় আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান ওরফে মিজানকে হত্যার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনিই আবরারকে শিবির বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

এরপর ৫ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে কয়েকজন আসামি সভা করে এ হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন রাতে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

আবরার হত্যা মামলায় চার্জশিটে (অভিযোগপত্র) উঠে এসেছে এসব তথ্য। ঢাকার হাকিম আদালতে বুধবার এ চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। এর মধ্যে ১১ আসামি সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। বাকি ১৪ জনকে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ততার কারণে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চার্জশিটে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে শিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করেন। আবরারকে প্রথম আঘাত করেন অভিযুক্ত মেহেদী হাসান ওরফে রবিন চার্জশিটে আবরারকে নির্মমভাবে হত্যার বর্ণনাসহ কোন আসামির কী ভূমিকা ছিল-তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, রুমমেট মিজানের দেয়া আবরারের বিরুদ্ধে শিবির করার তথ্যের ভিত্তিতে তাকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

শিবির সন্দেহ ও পিটিয়ে হত্যার পরিকল্পনা : চার্জশিটে বলা হয়, আবরার থাকতেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। একই কক্ষে থাকতেন ১৬তম ব্যাচের ছাত্র মিজানুর রহমান। তিনি আবরার হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত।

৪ অক্টোবরের আগে ‘আবরারকে শিবির বলে সন্দেহ’ হয় বলে মিজানুর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসানকে জানান।

মিজানুরের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মেহেদি হাসান ওরফে রবিন বিষয়টি শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের নিজস্ব ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানান। ৪ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের ক্যান্টিনে মেহেদি হাসান ওরফে রবিন এবং ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান মনির, মিফতাহুল ইসলাম জীয়নসহ অন্য আসামিরা মিটিং করেন।

ওই সময় আবরার তার রুমে আছে কিনা- তা জানতে খোঁজ নেয়া হয়। কিন্তু আবরার সেদিন হলে ছিলেন না। তিনি কুষ্টিয়ার নিজ বাড়িতে ছিলেন। পরদিন ৫ অক্টোবর মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বে আসামিরা গেস্টরুমে একত্রিত হয়ে মিটিং করেন। সেই মিটিংয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

যেভাবে নির্যাতন শুরু : চার্জশিটে বল হয়, গত ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মুজতবা রাফিদ তার সহযোগী ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে জানান, তিনি বাড়ি যাবেন। আবরারকে ধরলে আজই (৬ অক্টোবর) ধরতে হবে। এর কিছুক্ষণ পর হোসেন মোহাম্মদ তোহা সবাইকে জানান, আবরার গ্রামের বাড়ি থেকে হলে এসেছে।

এই খবর পাওয়ার পর সবাই ২০১১ নম্বর কক্ষে আবার একত্রিত হন। রাত ৮টার দিকে মেহেদী হাসান ওরফে রবিন ও ইফতি মোশাররফের নির্দেশে এহতেশামুল রাব্বি, তানিম মুনতাসির আল জেমি, এএসএম নাজমুস সাদাত আবুজার মিলে আবরারের কক্ষে যান। আবরার তখন ঘুমাচ্ছিলেন।

তানিম ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন এবং বড় ভাইয়েরা তাকে ডেকেছে বলে জানান। ২০১১ নম্বর রুমে যেতে বলেন। আবরার কখন যেতে হবে, কেন যেতে হবে তা জানতে চান। জবাবে তানিম বলেন, গেলেই দেখতে পাবি।

এরপর আবরারের ল্যাপটপ, মোবাইলসহ তাকে ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রুমে যাওয়ার পর আবরারের মোবাইল ও ল্যাপটপ চেক করেন তাবাখখারুল, ইফতি মোশাররফ ও মুজতবা রাফিদ। চেক করে একজন বলেন, আবরারের মোবাইলে শিবিরের তথ্য পাওয়া গেছে। তখনই মেহেদী হাসান ওরফে রবিন উত্তেজিত হন। আবরারকে তার চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলতে নির্দেশ দেন।

আবরার চশমা খোলার পরই মেহেদী হাসান ওরফে রবিন প্রচণ্ড জোরে তার মুখে কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। এরই মধ্যে মোরশেদ অমর্ত্য ইসলাম কাঠের তৈরি শক্ত ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসেন। ইফতি মোশাররফ জোরে থাপ্পড় মারেন আবরারকে। এরপর ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারের পিঠে, পায়ে, হাতেসহ বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আঘাত করতে থাকেন।

প্রচণ্ড মারধরের কারণে ক্রিকেট স্টাম্প দুই টুকরা হয়ে যায়। তখন এহতেসামুল রাব্বি ও তানিম আরও একটি ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে আসেন। এরপর অনিক সরকার একটি স্টাম্প হাতে তুলে নেন। অনিক একাধারে আবরারের সারা শরীরে ৫০ থেকে ৬০টি আঘাত করেন। এতে আবরার মেঝেতে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম ও শামিম বিল্লা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে দুই থেকে তিনটি আঘাত করেন।

আবরার ফাহাদ তখন বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। সেদিকে কর্ণপাত না করে মিফতাহুল ইসলাম ওরফে জীয়ন ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন এবং শিবির সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চান।

চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়, রাত ১১টার দিকে তখন ওই রুমে এসে হাজির হন এসএম মাহমুদ ওরফে সেতু। আবরারের ব্যাপারে উপস্থিত অন্যদের কাছ থেকে তিনি জানতে চান। তখন অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ ও মুজাহিদুল ইসলাম জানান, আবরার কোনো তথ্য দিচ্ছে না। তখন মাহমুদ ওরফে সেতু মারধর অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন।

এরপর আবরারকে আবার ক্রিকেট স্টাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে মারা হয়। আবার ইফতি মোশাররফ ও অনিক সরকার আবরারকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটাতে থাকেন। হাতের কনুই দিয়ে আবরারের পিঠে প্রচণ্ড আঘাত করেন। তখন সবাই মিলে প্রচণ্ড শক্তিতে আবরারকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়, লাথি মারতে থাকেন। এরপর ওই কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে অনিক সরকার ও মেহেদী হাসান ওরফে রবিন অন্যদের আবরারের কাছ থেকে তথ্য বের করতে বলে যান।

ওই সময় মনিরুজ্জামান মনির বলেন, তিনি আবরারের মোবাইল চেক করে শিবিরের তথ্য পেয়েছেন। এরপর মনিরুজ্জামান ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে থাকেন। তাবাখখারুল, নাজমুস সাদাত, এহতেশামুল তানিম, কাশীরাম জেমি আবরারকে চড়-থাপ্পড় মারেন। বাইরে থেকে আবার ওই কক্ষে ঢোকেন অনিক সরকার। তখন অনিক সরকার আবার আবরার ফাহাদকে প্রচণ্ড জোরে আরও ৪০ থেকে ৫০টি আঘাত করেন। তখন আবরার বমি ও প্রস্রাব করে ফেলেন।

বাঁচার জন্য ইশারা-ইঙ্গিতে কাকুতি-মিনতি করেন। এমন অবস্থায় আবরারকে হলের বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ধুয়ে-মুছে আবরার ফাহাদের জামাকাপড় বদলানো হয়। এরপর ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসানের নির্দেশে নাজমুস সাদাত, শামীম বিল্লাহ, শামসুল আরেফিন, আকাশ, মোয়াজ আবু হোরায়রা, মুনতাসির আল জেমি ও এহতেশামুল রাব্বি আবরারকে ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। ইফতি মোশাররফ হলের মেস বয় জাহিদ হাসানকে ডেকে আনেন। ২০১১ নম্বর কক্ষটি তাকে দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আবরার : চার্জশিটে বলা হয়, আবরার ফাহাদকে ২০০৫ নম্বর রুমে নেয়ার পর ইফতি মোশাররফ অন্যদের বলেন, তোরা (আসামিরা) এবার আবরারের কাছ থেকে তথ্য বের কর।

তখন মোয়াজ আবু হোরায়রা ও অমর্ত্য ইসলাম আবরারের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে জানান, ‘আবরারকে হাসপাতালে নিতে হবে।’ এ কথা শোনার পর মেহেদী হাসান ওরফে রবিন বলেন, ‘ও নাটক করছে। শিবির চেনস না। শিবির চেনা কষ্ট।’

রাত আড়াইটার সময় ইফতি মোশাররফ, মুজাহিদ, তাবাখখারুল ও তোহা মিলে আবরারকে তোশকে করে হলের দোতলার সিঁড়িতে রাখেন। এরপর আসামিরা বুয়েটের চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনেন। চিকিৎসক আবরারের দেহ পরীক্ষা করে ঘোষণা দেন তিনি মারা গেছেন।

আবরারকে হত্যার পর ক্রিকেট স্টাম্প, তোশক, বালিশ, আবরারের ল্যাপটপ, চাপাতি হলের ২০১১ নম্বর রুম থেকে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদের রুমে নিয়ে রেখে দেয়া হয়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ ওই হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে অপরাধ ঘটাতে সার্বিক সহায়তা করেন।

প্রসঙ্গত, বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন আবরারের বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ ২১ জনকে গ্রেফতার করে।

 

আরপি/ এএস



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top