রাজশাহী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


ভিক্ষাবৃত্তির টাকা-গরু দিয়েও মেলেনি ঘর


প্রকাশিত:
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০১:০৬

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৮:৩৮

ছবি: সংগৃহীত

রংপুরে গরু ও নগদ টাকা দিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের ঘর পাননি ভূমিহীন, ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষ। ঘর দেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য। এমনই অভিযোগ করেছেন মিঠাপুকুর উপজেলার শাল্টি গোপালপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মরিচটারি গ্রামের ভুক্তভোগীরা।

গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য সরকারের তৈরি নতুন ঘরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন ৩০ বছরের অসহায় ভিক্ষুক এনদা। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এমন একটি ঘর তারও পাওয়ার কথা ছিল। এ জন্য এনদার ভিক্ষাবৃত্তির সঞ্চিত ২৫ হাজার টাকাও নিয়েছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল জলিল মিয়া। সঙ্গে শেষ সম্বল গরুটিও নিয়ে গেছেন ওই ইউপি সদস্য। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বাকি টাকা দিতে না পারায় ঘরের বরাদ্দ পাননি।

অশ্রুসিক্ত নয়নে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভিক্ষুক এনদা মিয়া বলেন, ‘মেম্বার গরু-টাকা নিলে, ঘর তো দিলে না। কতো মাইনসে টাকা না দিয়া ঘর পাইছে। আর হামার এমন কপাল মেম্বারোক টাকার সতে (সঙ্গে) গরু দিয়্যাও একান ঘর পাইনো না। মোর মতো অন্দো (অন্ধ) ফকির মাইনসোক ঠকেয়া মেম্বার কি ভালো কাম করছে। উয়্যার (মেম্বারের) বিচার চাও। সরকার বিচার করুক।

নাইলে গরিবের টাকা মারি খাওয়া বন্ধ হবার নায়।’ ভূমিহীন এই ভিক্ষুক বলেন, ‘মুই তো ফকির। মাইনসের দুয়্যারোত ভিক্ষা করি খাও। নিজের থাকার মতো জাগাজমি নাই। মাইনসের জমিত কোনো মতে আচু। ভিক্ষা করি একান (একটি) গরু কিনিছিনু। ‌হামার জলিল মেম্বার সরকারের কাছ থাকি ঘর নিয়্যা দিবের কথা কয়া সেই গরুটা নিয়্যা গেইচে। মুই তো চোখে দেকো না। মোর মায়ের কাছ থাকিও ভিক্ষার জমা করার ২৫ হাজার টাকাও নেছে।

পঞ্চাশ হাজার টাকা চাচিলো, বাকি টাকা দেবার পাও নাই। এই জনতে (জন্যে) ঘর দিলে না। এ্যলা মোর ঘরও নাই গরুও নাই।’ কেউ গবাদিপশু বিক্রি করে, কেউ আবার চড়া সুদের ওপর ‍ঋণ নিয়ে টাকা দিয়েছেন ইউপি সদস্য আব্দুল জলিল মিয়াকে। এখন গরুও নাই, ঘরও নাই। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ওই গ্রামের মর্জিনা খাতুন। বয়স ষাটোর্ধ্ব।

অসহায় এই বৃদ্ধা বলেন, ‘মুই তো মাইনসের বাড়িত কাম করো। নিজের থাকার জমি নাই। মাইনসের জমিত থাকো। সরকারের কাছ থাকি মোক (আমাকে) ঘর নিয়্যা দেবে কয়া জলিল মেম্বার ৩০ হাজার টাকা নেচে। কিন্তু মেম্বার এ্যলা (এখন) মোক ঘরও দ্যাওচে (দিচ্ছে) না। মোর টাকাও ফেরত দ্যাওচে না।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘর দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন জলিল মেম্বার। কারো কারো কাছ থেকে গরু-ছাগলও নিয়েছেন। কিন্তু আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর বিতরণ কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আর কাউকে পাত্তা দিচ্ছেন না ওই ইউপি সদস্য।

মরিচটারি গ্রামের বদিউজ্জামানের স্ত্রী রসিদা বেগম (৩০) বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে দুইটা পাকা ঘর নিয়ে দিতে চেয়েছেন মেম্বার। কোনো অভাব থাকবে না। দুই শতক জমির ওপর ঘর থাকবে। সব রকম সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করে দিবে। অনেক কিছুই করে দিতে চেয়ে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছেন। কষ্ট করে ১০ হাজার টাকা মেম্বারের হাতে দিয়েছি। বাকি টাকা দিতে না পারায় মেম্বার ইট-বালু নিয়ে গেছে। এরপর থেকে মেম্বার সাইবের আর দেখা নাই। এখন তো শুনতেছি সবার কাছে টাকা নেচে। কিন্তু কাউকে ঘর দেয় নাই।’

একই এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে দুদু মিয়া বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার কথা বলে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। এখন টাকা ফেরত চাইতে গেলে গালিগালাজ করছেন। ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’ তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাল্টি গোপালপুর ইউপি সদস্য (মেম্বার) আব্দুল জলিল মিয়া।

তিনি ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের শিকার হচ্ছেন দাবি করে বলেন, ‘কারো কাছ থেকে আমি টাকা নেইনি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দিতে চেয়ে গরু-ছাগল ও টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো। আমার প্রতিপক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই চক্রান্ত করে যাচ্ছে।’

এ ব্যাপারে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন ভূঁইয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আবারও তদন্ত হবে। অন্যদিকে রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ‘গৃহহীন মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য আবাসন প্রকল্পের একটি করে ঘর পাচ্ছেন। যদি কেউ ঘর দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছি।’

আরপি / এমবি-৬



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top