'কালো বোরখা পরা মেয়েটি আজ স্বপ্নজয়ের পথিক'

রাজশাহী কলেজের অডিটোরিয়ামে জমেছে স্মৃতির মেলা। একেকটি মুখে হাসির রেশ, পুরনো দিনের গল্পে সিক্ত বাতাস। অডিটোরিয়ামে এক অন্যরকম পরিবেশ। চারপাশে স্মৃতির ঢেউ, পুরনো দিনের গল্পে ডুবে থাকা শত শত মুখ। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ শিক্ষক, কেউবা গবেষক। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ৭০ বছরের পথচলা উদযাপনে মিলিত হয়েছে সবাই। আলো-আঁধারির মাঝে এক শান্ত, দীপ্তিময় মুখ—কামরুন রহমান।
তিনি একসময় ছিলেন একা, কিন্তু আজ তার দেখানো পথে হাঁটছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। আজকের এই আনন্দ, এই উৎসবের পেছনে লুকিয়ে আছে এক সময়ের সংগ্রামের গল্প, যেখানে একা এক নারীর অদম্য ইচ্ছাশক্তি গড়ে তুলেছিল নতুন এক অধ্যায়।
ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর রাজশাহীতে স্বামীর সংসারে পা রেখেছিলেন কামরুন রহমান। তবে সংসারের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি, বরং তিনি চেয়েছিলেন আরও এগিয়ে যেতে, অনার্স পড়তে। রাজশাহী কলেজ তখন অনেক বিষয়ে অনার্স চালু ছিল, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস সেখানে ছিল না। কেন নেই? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারল না।
তবে তিনিও থেমে যাওয়ার মানুষ নন। এক শিক্ষকের পরামর্শে বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে দরখাস্ত জমা দিলেন, যাতে তারা ইসলামের ইতিহাসে অনার্স পড়তে পারেন। অধ্যক্ষ তখন কিছু না বললেও মুচকি হাসি দিয়ে দরখাস্তটি গ্রহণ করলেন। কয়েকদিন পর যেই শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় দরখাস্ত দেওয়া হয়েছিল, তিনিই এসে বললেন— "তোমাদের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আজ থেকেই ক্লাস শুরু করতে পারবে।"
সেই মুহূর্তে হয়তো কামরুন নাহার টের পাননি, কিন্তু ইতিহাস তখন ধীরে ধীরে রচনা হয়ে যাচ্ছিল। নতুন এক পথ তৈরি হচ্ছিল, যেখানে একদিন শত শত শিক্ষার্থী হাঁটবে।
স্নাতক শেষ করতেই তার সামনে খুলে গেল আরও বড় দিগন্ত। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হলেন। তার মে বান্ধবী ঢাকায় চলে গেলেও তিনি রয়ে গেলেন রাজশাহীতে, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল, তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই অবাক হয়ে গেলেন শিক্ষক থেকে শুরু করে ভাইস-চ্যান্সেলর পর্যন্ত।
ভাইস-চ্যান্সেলর তাকে ডেকে পাঠালেন। বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতার সুযোগ পেলেন তিনি। প্রথমে অস্থায়ী, পরে স্থায়ীভাবে। এভাবেই শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়, যেখানে কামরুন রহমান শুধু একজন শিক্ষক নন, এক পথপ্রদর্শক হয়ে উঠলেন। চার দশক ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম। সময়ের স্রোতে রাজশাহী কলেজ অনেক বদলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বদলেছে, কিন্তু বদলায়নি তার রেখে যাওয়া পদচিহ্ন।
আজ, সাত দশক পর যখন রাজশাহী কলেজের সেই বিভাগ উদযাপন করছে তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, তখন কামরুন রহমানের চোখে আনন্দাশ্রু চিকচিক করছে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন চারপাশে। একসময় যিনি ছিলেন একা, আজ তার দেখানো পথে হাঁটছে অসংখ্য শিক্ষার্থী।
তার কণ্ঠে আবেগের সুর। "আমি যখন প্রথম ক্লাসে ঢুকেছিলাম, তখন আমি একা ছিলাম। আজ আমার চারপাশে অসংখ্য মুখ। এই পরিবর্তন দেখার জন্যই তো আমার লড়াই ছিল!"
সময় বয়ে যায় নদীর স্রোতের মতো, কিন্তু কিছু পথিকের পদচিহ্ন রয়ে যায় চিরকাল। কালো বোরখা পরা সেই মেয়েটি, একদিন যিনি এসেছিলেন একা, আজ তিনি হয়ে উঠেছেন স্বপ্নজয়ের পথিক।
আরপি/আআ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: