রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

মোহনপুর কেমিক্যাল মিশ্রিত আম যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে


প্রকাশিত:
২২ জুন ২০২০ ২১:৫৩

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৫৮

ছবি: মোহনপুর কেমিক্যাল মিশ্রিত আম

বাংলাদেশ ক্রমে পরিণত হয়েছে ভেজালের দেশে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল ছাড়াও অন্যান্য পণ্যেও কমবেশি রয়েছে ভেজাল। এর প্রধান কারণ, ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়া। এসব কারণে জনস্বাস্থ্য পড়ে গেছে মারাত্মক হুমকিতে।

এখন বাজারে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে , আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তাল ইত্যাদি। এসব ফলকে বলা হয় রসালো মজাদার ও পুষ্টি খাবারসমৃদ্ধ। অনেকেই বলছেন এখনকার ফল আগের দিনের মতো মজাদার নয়। গন্ধও কম।

এরই মাঝে বিশ্বব্যাপী মরণঘাতী অদৃশ্য জীবানু করোনা ভাইরাসে লকডাউন সারা দেশ। লকডাউন শিথিল করায় আম প্রিয় গ্রাহকদের নজর কাড়তে রাজশাহীর মোহনপুর কামারপাড়া আম বাজারে আমে কেমিক্যাল স্প্রে করে তৈরি করা হচ্ছে টকটকে রং। যা আমে মেশালে আম পাকলেও তা পঁচবেনা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর আমের ভালো দাম পাচ্ছেন তারা। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি লাভের জন্য প্রতিদিন কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত আম ছোট বড় মিলিয়ে ১৪/১৫ ট্রাক ঢাকা, চট্টগ্রাম, শরিয়তপুর, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছে স্থানীয় আড়ত মালিকরা। যদিও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে আমের ক্ষতিও হয়েছে বড় ধরনের। চাষিরা চাইছেন, ভালো দামে বিক্রি করে আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে।

মোহনপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসসুত্রে জানা গেছে ‘চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১৩ হাজার ৩শ ৮৮ জন কৃষক ৪১৮ হেক্টর জমিতে আমের চাষ করেছেন। যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৪৪২ মে.টন। ঘূর্ণিজড় আম্পানের কারণে ২৫.২৫ হেক্টর বাগানের আম নষ্ট হয়েছে। এবছর ১৫ মে গাছ থেকে আম নামানো শুরু হয়। এ অঞ্চলের আমের মধ্যে ফজলি, হিমসাগর (খিরসাপাত), গোপালভোগ, মহনভোগ, ল্যাংড়া বিখ্যাত। এছাড়া মল্লিকা, ক্ষুদি খিরসাপাত, লখনা, আম্রপলি, আশ্বিনা জাতের আম রয়েছে।

শনিবার ২০ জুন কামারপাড়া আম বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের দু’ধারে শত শত মণ আম এই বাজারের ভ্যান গাড়িতে সাজানো। আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকাচ্ছেন। এ বাজারে আম কিনতে করোনার রেড জোন এলাকাসহ বিভিন্ন জেলা হতে এসেছেন অনেক পাইকার। তারা আমচাষিদের সাথে অবাধে মিশে আম কিনলেও সর্তক করছেন না কেহই।

সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত চলে বেঁচাকেনা। গত সপ্তাহের ব্যবধানে সব জাতের আমের দাম প্রতি মণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি মণ হিমসাগর (খিরসাপাত) ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা, ল্যাংড়া ১৩০০ থেকে ২২০০, লক্ষণভোগ ৮০০ থেকে ১১০০, গুটি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে আম কিনতে আসা ক্রেতা বিক্রেতাদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সামাজিক দুরত্ব বজায় ছিলনা। অনেকের মুখে নেই মাস্ক। বাজারের কোথাও নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। রায়ঘাটি ইউপির কামারপাড়া ব্লকে নিয়োজিত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাহারুজ্জামান ২/৩ দিন আম বাজারে খোজ রাখলেও প্রশাসন ও স্যানিটারি অফিসার আসাদুল ইসলামের বাজার মনিটরিং কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।

কামারপাড়া আম ব্যবসায়ী ও আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেন, প্রশাসন মোবাইলের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে তাদের মনিটরিং করছেন। স্যানিটারী অফিসার আসাদুল ইসলামকে তিনি বাজার মনিটরিং করতে দেখেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন,আড়তগুলো সরজমিনে মনিটরিং না করার কারণে বিভিন্ন ব্যবসায়ী আমে ইথিলিন, কার্বাইডসহ নানা রকম নামক ক্যামিক্যাল মিশিয়ে আম বাজারজাত করছেন। কামারপাড়া বাজারে মায়ের দোয়া ফল ভান্ডার,আকবর আলীসহ ১০/১৫ টি আড়ত আমে কেমিক্যাল মিশিয়ে ট্রাকলোড করে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে জনস্বাস্থ্য হুমকির ফেলছেন এমন অভিযোগ রয়েছে।

উপজেলার বিদিরপুর গ্রামের শাহীন কামারপাড়া আম আড়ত হতে ১০ কেজি হিমসাগর আম কিনে বাড়ীতে নিয়ে যান। ৩ দিনপরে আমের গোড়াগুলি পচে আমগুলি নষ্ট হয়ে যায়। কারণ হিসেবে জানা গেছে আমে মেশানো হয়েছে কেমিক্যাল।

কামারপাড়া বাজারে আম বিক্রয় করতে আসা উপজেলার রায়ঘাটি ইউনিয়নের তোফাজ্বল হোসেন (৪০) বলেন, আম বিক্রয়ের পর তা আড়তে নিয়ে ওজন দিয়ে ৪৭ কেজিতে মন ধরা হয়। এরপরও রিজেক্ট আমের নামে ২ থেকে ৩ কেজি আম বেশী নেয় আড়ত মালিকরা। এখানেই শেষ নয় আমের দাম পেতে বসে থাকতে হয় ২/৩ ঘন্টা। আমের বিভিন্ন দোষ ধরে কেনা দামের থেকে দাম কম দেয়া হয় বলে জানান তিনি।

নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার সাটইল গ্রামের পিয়ার আলী (৫৫) বলেন, আম বিক্রয় করলে সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে শতকরা ৬ টাকা আদায় করেন আড়ত মালিকরা। নিজস্ব ও সরকারী জমিতে আড়ত বসিয়ে খাজনা আদায়ের টাকা যায় আড়ত মালিকদের পকেটে। কামারপাড়া আম আড়ত থেকে সরকার প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

এ দিকে কামারপাড়া হতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আম পাঠাতে কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে পরিবহন খরচের ভোগান্তিতে বেকায়দায় পড়েছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। এ বাজারে ৪টি অনুমোদিত কুরিয়ার সার্ভিস ও পার্সেল এজেন্ট থাকলেও প্রতিটি আড়ত যেন এক একটি কুরিয়ার সার্ভিস এজেন্ট। ঢাকায় আম পাঠাতে আসা মিঠু নামের এক ব্যক্তি জানান, বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসে বিভিন্ন দর। কোনও কুরিয়ার সার্ভিস ঢাকায় প্রতিকেজি ৮ টাকায় নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বা ১৬ টাকা। তার অভিযোগ প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় আম পাঠাতে গলাকাটা ভাড়া আদায় করছেন আড়তদাররা।

এ এলাকার আম চাষীদের দাবি আম পচনশীল হওয়ায় গাছ থেকে আম নামানো শুরুর থেকে ২মাসের মধ্য বিক্রি করতে হয়। এতে করে দ্রুত সময়ে আম বিক্রি করতে হয় চাষিদের। ফলে অনেকেই নায্য মূল্য পান না তারা। চাষিরদের দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাঞ্চলে আম সংরক্ষণের জন্য হিমাগার ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছেন।

ফরমালিনের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা.মো. নাদিম মোস্তফা বলেন,ফরমালিন সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। ফরমালিনযুক্ত ফল,দুধ, মাছ, ইত্যাদি খেয়ে দিন দিন শিশুরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের মানসিক বিকাশ।

কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সকল বয়সের লোকজন। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা, বাচ্চার জন্মগত দোষত্রুটি ও প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হতে পারে। এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হওয়ার ও সম্ভাবনা রয়েছে। বিকলাঙ্গ রক্ষার স্বার্থে ফরমালিনকে না বলার সময় এখনই।

এ বিষয়ে মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানওয়ার হোসেন বলেন, নির্দিষ্ট পরিমান ইথিলিন ফলে মেশালে কোন সমস্যা নাই। আম ব্যবসায়ী ও চাষিদের সতর্ক করা হয়েছে। আমে কেমিক্যাল মিশিয়ে বাজারজাতকরণের চেষ্টা করলে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

 

আরপি/আআ-০৫



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top