রাজশাহী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ভুয়া প্রকল্পে ঋণ দেয় রাকাব!


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২৩ ০৭:০০

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৩৮

ছবি: রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।

ভুয়া প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। ঋণের বিপরীতে যে জামানত রাখা হয়েছে, তা ছিল জাল দলিলের মাধ্যমে সৃষ্ট। এছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ১২টি অনিয়মের মাধ্যমে ৮০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব কার্যক্রম নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয় এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে জানা যায়, ব্যাংকটির কর্মকর্তারা মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে দেয়া ঋণের অর্থ আদায় না হওয়া, দ্বিতীয় গ্রেডের কর্মকর্তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে ১১তম গ্রেডের কর্মকর্তাদের টিফিন ভাতা আত্মসাৎ, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও কর্মকর্তারা জালিয়াতি ও ভুয়া ঋণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের শাখাগুলো নিয়ে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় রাকাব। লক্ষ্য ছিল, কৃষি খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের ১৬ জেলার উন্নয়ন। কিন্তু রাকাব কর্মকর্তারা আর্থিক অনিয়ম ও বিধি-বিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে ৮০ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৯ টাকা তছরুপ করেছে।

রাকাবের মূল কাজ হচ্ছে শস্য, মৎস, প্রাণিসম্পদ, গাভী পালন, কৃষি যন্ত্রপাতি, শস্য গুদামজাত ও বাজারজাতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষিভিত্তিক শিল্প ঋণ বিতরণ, এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দ্রুত স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়াসহ প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজ করা। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের চেয়ে জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া তথ্যে ঋণ দিতেই কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি। ১৩টি ধাপে ব্যাংকটির অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে এই নিরীক্ষায়।

কোন খাতে কত অনিয়ম: রাকাবের প্রধান কার্যালয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে জমার রশিদে আদায় করা অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা না করে জালিয়াতির মাধ্যমে ১ কোটি ১২ লাখের বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। রাকাব বড়ভিটা শাখার ক্যাশিয়ার ও সুপারভাইজার শাখার ব্যবস্থাপকের একক স্বাক্ষরে জমা রশিদে পাওয়া অর্থ ব্যাংকে জমা করেনি। ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে ভুয়া পরিচয়পত্র, ওয়ারিশ সনদ, বিক্রি হয়ে গেছে এমন জমির ভুয়া ও টেম্পারিং কাগজপত্র গ্রহণের মাধ্যমে সুপারভাইজারের সুপারিশে এ অর্থ মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়।

ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও ব্যাংক কর্মকর্তারা জালিয়াতি ও ভুয়া ঋণ তৈরির মাধ্যমে ৯৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বেশি আত্মসাৎ করা হয়। রাকাব বেলকুচি শাখায় কর্মরত ৫ জন এবং অবসরে যাওয়া ৩ জন কর্মকর্তা মিলে পাসওয়ার্ড উš§ুক্ত করে ভুয়া ঋণ, ভুয়া ব্যক্তির চেকে পে-অর্ডার, স্বাক্ষর জাল, চেক জালিয়াতি ও ভাউচার ছাড়া লেনদেন করার মাধ্যমে এ অর্থ কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেন।

মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে দেয়া ঋণ আদায় করতে না পারার কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। রাকাব প্রধান কার্যালয় ২০০৩ সালে আজমেরী হিমাগার লিমিটেডকে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য ৩ একর ১ সাড়ে ২৫ শতক প্রকল্প ভূমি ও প্রকল্পের  যন্ত্রপাতি বন্ধক রেখে সাড়ে ১২ শতাংশ হার সুদে ঋণ দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রকল্পটি বন্ধ থাকা ও ঋণ আদায়ে তদারকির দুর্বলতার কারণে ঋণটি মন্দ ঋণে পরিণত হয়। পরে নিলাম করার পর এ ঋণে ১৫ কোটি ৭২ লাখ টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়।

প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০০৫ সালে মেসার্স গোল্ড মুনকে ১ একর ৩৬ শতক জমিতে মিল ঘর, গোডাউন ও অফিস, চারকোল গোডাউন, ব্রয়লার শেড ও মেশিনারিজ সহায়ক জামানত হিসেবে ঋণ নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে সরেজমিনে দেখা যায়, যে স্থানে প্রকল্প করার কথা ছিল সেখানে ২টি মোটর, ২টি হলার মেশিন, তুষ ও কুঁড়ার বস্তা ছাড়া আর কিছুই নেই। তা-ও সেই দুটি হলার তুষ থেকে কুঁড়া উৎপাদন করার জন্য ভাড়াটিয়ার মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফিড মিল স্থাপন করতে যে ঋণ নেয়া হয় তার কোনো নমুনা নিরীক্ষা দল খুঁজে পায়নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভুয় প্রকল্প দেখিয়ে ১ কোটি ৪৬ হাজার টাকার বেশি লোপাট করা হয়।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে প্রকল্প ঋণ দেয়ার কিস্তি আদায় না হওয়া সত্ত্বেও একই ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দেয়ায় সে ঋণগুলো মন্দ ঋণে পরিণত হয়। শর্ত ভঙ্গ করে শেরপুরের এগ্রো আর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ও দুপচাঁচিয়া শাখার সাদাত কোল্ড স্টোরেজকে ঋণ দেয়া হয়। পরে এ দুই গ্রাহকই নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণগুলো মন্দ ঋণে পরিণত হয়। এই দুই প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণগুলো মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার কারণে ব্যাংকের অনাদায়ী দাঁড়ায় ২২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বেশি।

রাকাব প্রধান শাখার আওতাধীন পাবনা, রংপুর ও দিনাজপুর শাখা প্রাপ্য আনুতোষিক থেকে গৃহনির্মাণ অগ্রিমের পাওনা আদায় না করে তা অবসর গ্রহণকারীদের নামে সঞ্চয়পত্র/স্থায়ী আমানত খাতে বিনিয়োগ দেখিয়ে এবং বিনিয়োগ করা অর্থের আয় থেকে গৃহনির্মাণ অগ্রিমের পাওনা সমন্বয় করার কারণে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

সিএজির নিরীক্ষায় চাকরি আদেশ ২০১৫ লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় থেকে দশম  গ্রেডের কর্মকর্তাদের প্রতিদিন উপস্থিতির জন্য ২০০ টাকা করে লাঞ্চ ভাতা দিয়ে এসেছে। কিন্তু চাকরি আদেশের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১১তম গ্রেড থেকে ২০তম  গ্রেডের কর্মচারীদের মাসিক ২০০ টাকা হারে টিফিন ভাতা পাবেন। কিন্তু দ্বিতীয়  গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা কোনোভাবেই টিফিনের ভাতা পাবেন না এবং দৈনিক ভিত্তিতে এ টাকা দেয়ার সুযোগ না থাকার পরও কর্মকর্তারা নিয়মিত এই টিফিনের টাকা নেয়ার ফলে দুই অর্থবছরে (২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১) ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকার বেশি।

নিরীক্ষায় দেখা যায়, রাফা অটোমেটিক অ্যারোমেটিক রাইস মিল ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে ৯০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। অঙ্গীকার অনুযায়ী, ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এছাড়া আরও অন্যান্য যেসব শর্তে ঋণটি নেয়া হয় সেসব শর্তের একটিও পরিপালন করা হয়নি। ঋণ মঞ্জুরিপত্রের ১৪নং শর্তানুযায়ী ঋণের টাকার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পরিদর্শন ও তদারিকর দায়দায়িত্ব ব্যাংকের শাখায় জমা দেয়ার কথা থাকলেও শাখা ও জোনাল ব্যবস্থাপকের যথাযথ তদারকির ঘাটতির কারণে এই টাকায় আদায় হয়নি। ফলে ঋণটি মন্দ ঋণে পরিণত হয়।

রাকাব প্রধান কার্যালয়ের আওতাধীন রংপুর শাখার পুনঃতফসিলের শর্ত লঙ্ঘন করে প্লেজ ঋণের ও প্রকল্প ঋণের টাকা আদায় না করার কারণে ব্যাংকের ৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার বেশি অনাদায়ী রয়ে গেছে। ২০১৪ সালে শাহ আমানত স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজকে প্লেজ ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু গ্রাহক এ ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে এক বছর পর ২০১৫ সালে পুনঃতফসিলকরণ করা হলেও গ্রাহক পুনঃতফসিল অনুযায়ী কিস্তির টাকা পরিশোধ করেনি।

ভুয়া ওয়ারিশ সার্টিফিকেট ও জমির জাল কাগজপত্র দেখিয়ে শস্য ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করার পর ঋণগুলো অনাদায়ী থাকায় ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৯৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকার বেশি।

নিরীক্ষায় উঠে আসে, স্থায়ী আমানতের বিপরীতে অতিরিক্ত হারে সুদ দেয়ার কারণেও ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। রাকাব আওতাধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সৈয়দপুর ও কুড়িগ্রাম শাখায় স্থায়ী আমানতের বিপরীতে অতিরিক্ত হারে সুদ দেয়ার কারণে ব্যাংকের ১৯ কোটি ৮ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

চাকরি আদেশ ২০১৫ অনুযায়ী প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা সমতা করে বেতন নির্ধারণ, ছুটি নগদায়ন, আনুতোষিক, পেনশন ও বেতন ভাতাদি পরিশোধ করার কারণে ব্যাংকের ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথকে ফোন দেয়া হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান। পরে ফোন দেয়া হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।

 

আরপি/এমএএইচ 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top