রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

মা-বাবার সামনে সন্তানকে পিটিয়ে হত্যা


প্রকাশিত:
১৮ মার্চ ২০২১ ২৩:৫১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৩:১৪

ছবি: ছেলের কবরের নিহতের মা মুনজুয়ারা বেগম

রাজশাহীর দুর্গাপুরে পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র মূলক জমির মাপ কখনো এমন হয়নি। "কাকা আপনার দুইটা পা ধরি দরকার হয় আমি জমি মাপতে সরকারি আমিন আনবো আজ বরজ বান্ধেন না বলছিলেন নিহত মাহাবুর"। এ নিয়ে বাকবিতন্ডা হতেই আমার এক সন্তানকে দুই হাত পেছনে নিয়ে ধরে রেখে আর মাহবুরকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সবাই মিলে খুঁচতে থাকে। এভাবে আমার সন্তানকে আমার চোখের সামনে নির্মম ভাবে হত্যা করা হলো।

এখন আর কেও বলবেনা আমায় বলবে না মা দরজা খুলো? কে বলবে মা তোমার কি লাগবে? আমার দুইডা নাতি এতিম হয়ে গেলো এদের কি হবে? সন্তান হত্যার বিচার চাই, আপনাদের সকলের কাছে।
বলছিলেন নিহতের মা মুনজুয়ারা বেগম।

আমি কল্পনা, বাবাকে মারছে এই খবর পেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দেখি আমার বাবার বুকে খাম, ছোট্ট ভাইটি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। মেডিকেলে নিয়ে যেতেই আমার আব্বু মারা গেছে। আমার বাপ আমার ভাই হবার আগে আমাক আব্বা আব্বা করে ডাকিচ্চিলো, আমার ভাই হবার পড়ে কোনোদিনও আম্মু ছাড়া ডাকেনি,কোনোদিনও নাম ধরে ডাকেনাকো, যেটা চাবো সেটাই লিয়াসে দেয়। আমার সোনার বাপকে মাইরে ফেললো আমাকে কেও আর কোনো দিনও মা বলে ডাকবে না।

পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু নাকি বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। কোনো সন্তানকে যদি মা-বাবার চোখের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তা কে সইতে পারে? সেই মা-বাবা কী নিয়ে বাঁচবে। বলেন, নিহতের বাবা আজাদ আলী।

জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে গত ৬ মার্চ শনিবার প্রতিপক্ষের হামলায় প্রাণ হারান দুর্গাপুর উপজেলার ৭নং জয়নগর ইউনিয়নের পারিলা গ্রামের আজাদ আলীর বড়ো সন্তান অটোরিকশা চালক মাহবুর রহমান (৩৮)। ছোট্ট ২ নাবালক সন্তানদের আহাজারিতে বাকরুদ্ধ পুরো পরিবার। কি হবে সন্তানদের ভবিষ্যৎ?
ঘটনার সুত্রপাত মাত্র এক হাত বরজের জমিকে কেন্দ্র করে। কয়েক দশক ধরে পূর্বের সীমানায় উভয় পক্ষ জমি ভোগদখল করছিলেন বিরোধ দেখা দিলে। প্রাথমিক অবস্থায় মাহাবুরের পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন, তাঁরা নিজেরা আপোষ করবেন তা জানান।

পরক্ষণে এএসআই সাফিরুল ওয়ার্ড কমিশনার বাবর আলীকে বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য অনুরোধ করেন। আসামী পক্ষের ভূমি জরিপকারী আমিন রবিউল জমি পরিমাপ করে জমির সীমানার অনেক পরিবর্তন করেন। ফলে নিহতের পান বরজের মধ্যে প্রায় ৬ হাত ভেতরে জমির সীমানা নির্ধারণ করা হয়। আসামি পক্ষ উক্ত রায় প্রত্যাখ্যান করে সরকারি আমিন আনার কথা বললে তাতে তারা কর্ণপাত করেনি। গত শনিবার আসামী পক্ষ নতুন সীমানার বরজ বাঁধতে গেলে পান বরজের প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন পুরো পরিবার। নিহতের পরিবারের ভাষ্যমতে, গণপিটুনি দিয়ে মাহবুবকে কে নির্মম ভাবে পান বরজেই হত্যা করা হয়।

সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাদী ও বিবাদীর আলাদাভাবে পাশাপাশি দু'টি পান বরজের অবস্থান। দুই বরজের পান গাছ ভিন্ন ধরনের যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় দুটি পৃথক বরজ। নতুন সীমানা নির্ধারণের ফলে নিহত মাহাবুরের বরজের আনুমানিক ৬ হাত ভিতরে নতুন সীমানা নির্ধারণ হয়। তখন থেকেই বিরোধের সুত্রপাত হয়, আসামিরা সকলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন সকলের বাড়ি তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। এলাকার বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য কেউ নিশ্চিত করেননি প্রায় সকলেই অজানা আতঙ্কে দায় এড়ানো সাক্ষাৎকার দেন।

তাদের মধ্যে কাবুল নামে একজন বলেন, আমি চা খেয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি বরজের ওখানে অনেক মানুষজন বাহিরে মেয়েরা মারামারি করছিলো তাদের ছাড়িয়ে দিয়েছি। বরজের ভেতরেও মারামারি হচ্ছিল মানে হাত দিয়ে মারামারি, একটু পড়েই দেখি একজন মাহাবুরকে ধরে বের করে নিয়ে আসতে দেখেছি। তারপর তাকে বাড়িতে নিয়ে যায় মাহাবুরের বাবা আমায় বলে এদিকে আয় আমার সন্তান মারা যাচ্ছে। তখন গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় গলার নিচের দিকে একটু খাম দেখি, জ্ঞান ছিল কিন্তু কথা বলতে পারছিলনা। তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

আবার উক্ত ওয়ার্ড কমিশনার বাবর আলী ঘটনা স্থলে উপস্থিত থাকলেও মারামারি ভালোভাবে দেখেনি কে কাকে মেরেছে সেটাও জানেনা, এমনটি বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় কিছুটা প্রভাব বিস্তার লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্নভাবে সংবাদকর্মীদের বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কমিশনার এর স্ত্রী কেন ভিডিও গ্রহণ করা হচ্ছে এই মর্মে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং সংবাদকর্মীদের তার সমর্থকরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেন কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। বাধার ফলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন উপস্থিত বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক বৃন্দ। বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে । এবং আসামিরা সমাজের প্রভাবশালী হওয়ার কারণে ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা সাধারন মানুষ। নিহতের ঘটনায় ১০ দিন পেরলেও এই পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি দুর্গাপুর থানা পুলিশ।

এবিষয়ে আমিন রবিউল ইসলাম বক্তব্য নিতে গেলে বিভিন্ন ভাবে সাংবাদিকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন ফোনে বিভিন্ন ব্যাক্তি দ্বারা তদবির করান। সকালের বক্তব্য বিকালে দিতে চান, সন্ধ্যায় চাইলে একটু পড়েই লিখিত দিতে চান। পরক্ষণে তিনি তাঁর বাড়ি আমগ্রামে চলে যান। ফোনে যোগাযোগ করলে আপনার যা ইচ্ছে তাই লেখেন বলে জানান, তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলে, আমগ্রাম আসতে বলেন, আমগ্রাম গেলে তিনি উক্ত বাজারে না এসে সামনে এগিয়ে নির্জন স্থানে ডাকেন। নিরাপত্তার কারণে সংবাদ কর্মীরা ফিরে চলে আসেন। এবং তাঁর বক্তব্য তিনি স্পষ্ট করেননি।

এবিষয়ে সাপলা আমিন সমিতির সভাপতি আব্দুল সালাম জানান, আমরা মানুষকে সেবা দিয়ে থাকি, শুনছি মাপ নিয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে এটি আত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। রবিউল আমাদের সমিতি ভুক্ত আমিন,তদন্ত সাপেক্ষে দোষী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হোক।

মামলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন দুর্গাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ ওসি হাশমত আলী জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাঁর সকলেই বাড়ি থেকে পলাতক রয়েছেন।

এবিষয়ে রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(সদর) ইফতেখার আলম বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে, আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আরপি/ এসআই-১



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top