রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধ মায়ের জায়গা হয়েছে ফুটপাত, ফিরতে চান ঘরে


প্রকাশিত:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৩২

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১০:১৮

বৃদ্ধ মায়ের জায়গা হয়েছে ফুটপাত, ফিরতে চান ঘরে

ফুটপাতের এক কোনে ছোট্ট একটি চুলা, থরে থরে সাজানো ছোট-বড় দইয়ের ময়লাযুক্ত খালি কাতারি (দই রাখার মাটির বাসন), পাশেই পড়ে আছে ময়লাযুক্ত পোশাক। ছোট্ট সেই চুলাটির উপর একটি ময়লাযুক্ত দইয়ের খালি কারাতির ভেতরে একটি ছোট্ট লাঠি দিয়ে নাড়াচাড়া করছেন অর্থ উলঙ্গ ময়লাযুক্ত পোশাকের এক বয়ঃবৃদ্ধ নারী। মনের আনন্দে মুচকি হাসি নিয়ে যেন রান্নায় ব্যস্ত সময় পারছেন তিনি।

এভাবেই কিছুক্ষণ চলার পর শুয়ে পড়লেন তিনি। কখনো আবার ফাঁকা আকাশের নিচে ময়লাযুক্ত কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে থাকেন এ নারী। কখনো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় কী যেন বলতে থাকেন। যা সে নিজেই বলে আর নিজেই হাসে। অন্যরা তেমন কিছুই বোঝে না।
এমনভাবেই রাজশাহী নগরীর কোর্ট এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে গত কয়েক মাস থেকে অবস্থান নুয়ে আছেন মানসিক ভারসাম্যহীন অজ্ঞাত এই নারী। ঘন কুয়াশা ও শীতের মধ্যেও খোলা আকাশের নিচে ফুটপাতেই শুয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।

আশেপাশের অনেকেই তাকে খাবার দিয়ে থাকেন। সর্বশেষ গত কয়েকসপ্তাহ আগে বিষয়টি নজরে আসে স্থানীয় কাউন্সিলরের। শীতের মধ্যে এই নারীকে কষ্ট পেতে দেখে ফুটপাতের উপর ছোট্ট করে চাটাইয়ের ঘর তুলে দেন তিনি। তবে তার পরিচয় সর্ম্পকে জানতে পারে নি কেউ।

বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুর আড়াইটা। রাজশাহী প্রাথমিক শিক্ষা রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতের এক কোণে ছোট্ট খুপরি ঘরে শুয়ে থাকতে দেখা যায় মানসিক প্রতিবন্ধী এ নারীকে। খুপরি ঘরের মধ্যে অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিলো ছোট-বড় ময়লাযুক্ত সেই কাতারি।

পাশে একটি রান্না করা কড়াইয়ের উপর কিছু খাবার। শরীরের অর্ধেকটা ঘরের বাইরে ও অর্ধেকটা ভেতরে রেখে খাবার খাচ্ছিলো সে। কাছে যেতেই ভেসে আসে বিদঘুটে র্দুগন্ধ। মুচকি হাসিতে যেন সাদরে গ্রহণ করে কথা বলতে শুরু করেন এ নারী। তবে তার অধিকাংশ কথাই বোঝা যায়নি। জিজ্ঞেস করলে অস্পষ্ট ভাষায় বলতে থাকেন তার বাড়ি ধামুইরহাট। তার ছেলেরা তাকে এখানে রেখে গেছে। এখানে তাকে খুব ঠান্ডা লাগে। আর তার খাবারও শেষ। তার ছেলে মাঝে মধ্যে এখানে আসে। তার ছেলে ধান কাটে। তিনি বাড়ি যেতে চান। এর চেয়ে বেশি কিছু বোঝা সম্ভব হয় নি তার কথা শুনে।

এলাকার আশেপাশের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক মাস থেকে এই নারী খোলা আকাশের নিচে নোংরা মেখে ফুটপাতে শুয়ে থাকেন। কখনো আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। বিষয়টি অনেকের হৃদয়ে নাড়া দেয়। স্থানীয় কমিশনারের সহযোগিতায় কয়েকজন মানুষ গত কয়েকদিন আগে ফুটপাতে তাকে এই ছোট্ট চাটাই ঘর তুলে দিয়েছে।

জানা যায়, এই নারীকে অনেকেই সাহায্য করে থাকেন। খাবারসহ পোশাকও দিয়ে যায়। কিন্তু সেই পোশাকগুলো পরবর্তীতে আর দেখা যায় না। কয়েকজন সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, তার ছেলে মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। যেটা এই নারীও নাকি বলে থাকেন।

প্রাথমিক শিক্ষা রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের কর্মচারী হাসানুজ্জামান জানান, তাদের অফিসের সামনে কয়েক মাস থেকে এই নারী অবস্থান করছেন। আশেপাশের অনেকেই তাকে খাবারসহ সাহায্য সহযোগিতা করে। স্থানীয় কাউন্সিলর তাকে চাটাই দিয়ে একচি ছোট্ট ঘরও তুলে দিয়েছেন।

পাশেই একটি দোকানের মালিক ড্যানি জানান, এই অজ্ঞাত নারীকে তিনি দাদি বলে ডাকেন। তিনি প্রায়শই তাকে খাবার দিয়ে আসেন। তার সব কথা তিনি না বুঝলেও কিছু কথা বুঝতে পারেন। তিনি এই নারীকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছেন তার ছেলে মেয়ে আছে কিনা।

সে বলেছে তার ছেলে আছে এবং দেখাও করতে আসে। তবে তিনি কখনো তার ছেলেকে দেখেন নি। কেননা অনেকেই তাকে খাবার, পোশাক ও অর্থ দিয়েও সহযোগিতা করে। কিন্তু এগুলো কোথায় যায় এটা নিয়ে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, হয়তো তার ছেলেরাই এগুলো নিয়ে যায়। এ সময় তিনি এ নারীকে সেইফ কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে মত ব্যক্ত করেন। কেননা সরকারি অফিসের সামনে এভাবে থাকলে পরিবেশটাও অন্য রকম দেখায়।

এ বিষয়ে ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. রুহুল আমিন জানান, তিনি জানতে পেরেছেন এই অজ্ঞাত নারী কয়েক মাস থেকে এখানে অবস্থান করছেন। শীতের মধ্যে খোলা আকাশের মধ্যে তাকে দেখে কয়েক সপ্তাহ আগে চাটাই দিয়ে ফুটপাতের এক কোণায় তাকে ঘর তুলে দিয়েছেন। আশেপাশের অনেকেই তাকে খাবার দিয়ে থাকে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্তজার্তিক বিষয়ক সম্পাদক রেখা সাহার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, এ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। রাস্তায় এই মানসিক ভারসাম্যহীন নারী দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার খাওয়ার ঠিক নেই, চিকিৎসা তো দুরের বিষয়। কিন্তু সরকারি কোন সংস্থা তার কোনো খোঁজও নেয়নি। অন্তত সমাজসেবা অধিদপ্তর এসব নারীদের নিয়ে কাজ করতে পারে।

এ বিষয়ে রাজশাহী সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাসিনা মমতাজ জানান, রাজশাহীতে এমন মানসিক ভারসাম্যহীনদের জন্য বিশেষায়িত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এমন কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে আদালতের মাধ্যমে রাজশাহীর একটি সেইফ হোমে রাখা হয়। কিন্তু যারা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় এমন নারীদের সেইফ হোমে রাখা সম্ভব নয়। কেননা সেইফ হোমে এরই মধ্যে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুন রোগি আছে।

আরপি/ এআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top