আয় কম হোক তবু সন্তান বাড়িতে থাকাই ভালো’

শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) দিবাগত রাত। ঘড়ির কাঁটায় ১টা বেজে ১০ মিনিট। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বারন্দায় বসে বসে ঝিমুচ্ছেন রতন আলী। বেঞ্চের একপাশে হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন যেন ঘুমের ঘোরে পড়ে না যান। চোখদুটো জবা ফুলের মতো টুকটুকে লাল হয়ে উঠেছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে জ্যাকেট। কানে মাফলার জড়িয়ে ঠেলছেন কুয়াশাভেজা শীতল রাত। রাত যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
স্ত্রী শাহানাজ বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন রতন আলী। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মেরিগাছা থেকে রাত ১০টায় পাড়ি দিয়ে কুয়াশা ভেদ করে পৌঁছেছেন ১২টায়। হঠাৎ স্ত্রীর পেটে জালাপোড়া শুরু হলে বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করান। অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তাররা পাঠিয়ে দেন রাজশাহীতে। প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়ে কিছুটা শান্ত হয়েছেন তার স্ত্রী। এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বারান্দার বেঞ্চে বসে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করছেন তিনি।
রতন আলীর বয়স ৫০ পেরিয়েছে। চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। খোঁচা-খোঁচা গোফের আড়ালে আফসোসের ভাষা স্পষ্ট। শিল্পী নচিকেতার গানের সাথে যেন মিলে গেছে জীবন। দুই সন্তান বিদেশে থাকেন। রোজগার করে প্রতিষ্ঠিত তারা। দেশে অসুস্থ হয়ে মা হাসপাতালে ভর্তি। অসুস্থ বয়স্ক বাবা একবার মেডিকেলের ওয়ার্ডে আবার কখনো ঔষধের স্টোরে ছুটছেন। যে করেই হোক স্ত্রীকে বাঁচাতে হবে। আহ! একটা ছেলে কাছে থাকলে কতই না ভালো হতো!
জীবনের পাড়ি দেয়া দিনগুলো রতন আলীর ঘুম জড়ানো চোখে ভেসে ওঠে। তিনি জানান, বড় ছেলেকে পুলিশের চাকরি পাইয়ে দিতে ৫ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছিলেন। ২ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে যখনই ৭ লাখ টাকায় চাকরির বন্দোবস্ত হয়, ঠিক তখনই দালাল উধাও। চাকরি না হওয়ায় সেই টাকায় বড় ছেলে রওশন আলমকে (২৩) মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে পাঠিয়ে দেন। ঘোঁচে সংসারের টানাপোড়ন।
এর দু’বছরের মাথায় উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছোট ছেলে শামীম হোসেন (১৮) কিশোর বয়সের গোলকধাঁধাঁয় হারিয়ে যেতে বসে। আবেগ ও জেদের বশবর্তী হয়ে ১ মাসের মধ্যেই প্রেমিকার কাছ থেকে দুরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনটা না হলে আত্মহত্যা করবে বলে জানায়। লেখাপড়ার চেয়ে সন্তান বেঁচে আছে সেটাই বড় কথা। তাই বড় ছেলের দেয়া টাকা আর জমি বিক্রির টাকায় পড়াশুনা ছাড়িয়ে পাঠিয়ে দেন কাতারে। বর্তমানে তারা দুই ভাই থাকেন দেশের বাইরে। ছোট বোনের বয়স মাত্র ৮ বছর। মায়ের সাথে সেও হাসপাতালে এসেছে। কিন্তু অনেক ছোট হওয়ায় বাবাকে তেমন কোন সাহায্য করতে পারছে না সে।
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে রতন আলী বলেন, “ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ার সময় হটাৎ ছেলে একদিন বলল, ১ মাসের মধ্যে বিয়ে দাও, নাহলে বিদেশ পাঠাও। কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিদেশ না পাঠাতে পারলে আত্মহত্যা করবে। তাই ছোট ছেলেকে কাতার পাঠালাম। এখন দুই ছেলে বিদেশ থাকে, টাকা পাঠাই মাসে ৭০ হাজার। আর আমি হাসপাতালে তাদের মা’কে নিয়ে অসহায়।”
দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে ভুল করেছেন বলে আফসোস প্রকাশ করেন রতন আলী। অনুশোচনার সুরে বলেন, “মানুষের সুখের দিন আসলে বিদায় নিতে হয়। দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে এখন মাসে ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। বড় ছেলে পাঠায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার, ছোট ছেলে পাঠায় ৩০ হাজার। জমি বিক্রি করেছিলাম, এখন জমি কিনছি। সুখের দেখা মিলতে না মিলতেই হাসপাতলের বেডে। এজন্যই বলবো, আয় একটু কম হোক তবুও ছোট ছেলেকে বাড়িতে রাখা উচিত ছিল।”
হাসপাতালে রোগীর পাশাপাশি স্বজনরা গরম কাপড় বা কম্বল পাওয়ার সুযোগ থাকলে শত শত মানুষকে কষ্ট লাঘব হতো বলে মন্তব্য করেন রতন আলী। তিনি বলেন, “হাসপাতালে মানুষ বিপদে পড়ে আসে। হাসপাতাল থেকে একটা করে কম্বল দিলে কতই না ভালো হতো। বড়াইগ্রাম হাসপাতালে একটা করে কম্বল রোগীর সাথে যারা যায় তাদের দেওয়া হয়, আবার নিয়ে নেয়। রাতে শীতের মধ্যে এই বেঞ্চে বসে থাকা যায়? হাসপাতালে এরকম একটা ব্যবস্থা নাই। আবার রোগী রাখার জায়গা নাই। সিট কম থাকায় মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। হাসপাতালকে আরো উন্নত করা দরকার।”
আরপি / আইএইচ-০৩
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: