রাজশাহী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

জৌলুস হারিয়ে নিস্প্রভ ঐতিহ্যবাহী ঘোড়াদহ মেলা


প্রকাশিত:
২১ অক্টোবর ২০২০ ১৭:২৬

আপডেট:
২১ অক্টোবর ২০২০ ১৭:২৮

ছবি: রাজশাহী পোস্ট

ঘোড়াদহ মেলা। ঐতিহ্যবাহী এই মেলাটি প্রতি বছর আশ্বিন মাসের শেষ দিনে শুরু হয়। শত শত বছর ধরে চলে আসা মেলাটির জন্ম ইতিহাস ও নামকরণ সম্পর্কে ঠিকঠাক কেউই বলতে পারেন না।

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কিসমতগণকৈড় ইউনিয়নের উজালখলসী গ্রামে বসে মেলাটি। তাই অনেকে এটাকে উজালখলসীর মেলা নামে জানেন। গ্রামের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত আয়চাঁন নদীর উত্তরপাড় মেলাস্থল। 

অতীতে দীর্ঘদিন চলতো মেলাটি। উপজেলা-জেলা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসতেন মেলাতে। কিন্তু গত কয়েক বছরে কমেছে মেলার জৌলুস, আর করোনায় সেটা আরও নিস্প্রভ হয়ে পড়েছে। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও অনুষ্ঠিত হয়েছে মেলাটি। তবে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে গত শনিবার ও রোববার; এই দুই দিন স্থায়ী হয়েছে মেলাটি। ঠিক কতদিন থেকে এই মেলা বসছে তা কেউই ঠিকভাবে বলতে পারেন না। 

মেলা সংলগ্ন আয়চাঁন নদীর অপরপ্রান্তে ভবানীপুর গ্রাম। সেই গ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ এনায়েত শাহের বয়স ৯০ ছুঁইছুঁই। তিনিও বলতে পারলেন না মেলার সঠিক বয়স। প্রবীণ এই ব্যক্তি বলেন, মেলা আগে জবর হচ্ছিল। লাউখেলা (নৌকাবাইচ) হইতো। সেই উপলক্ষ্যে অনেক মানুষ আইসতো। এখন কম মানুষ আইসতে। কেন ‘ঘোড়াদহ মেলা’ নাম হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনিই, আগে থাইক্যাই। তার বাপ-দাদারাও এই নাম শুনেছেন এবং এই সম্পর্কে সঠিক কোন ইতিহাস জানা নেই বলে জানান প্রবীণ এনায়েত শাহ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বহু বছর থেকে মেলা বসছে এই গ্রামে। ঠিক কত বছর ধারণা নেই। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, জন্মের পর থেকেই তারা দেখছেন মেলাটি। তাদের বাবা-দাদারাও ছোটবেলা থেকে এই মেলা দেখেছেন, এবং উনাদের পূর্বপুরুষেরাও এই মেলা ছোটবেলা থেকে দেখেছেন ও শুনেছেন বলে জানা গেছে। তাই মেলার বয়স ৫’শ না ৬’শ বছর তা কেউই জানেন না।

তেমনি জানেন না কেন এর নাম ‘ঘোড়াদহ মেলা’। মেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ আফজাল হোসেন ও অন্যান্যদের দেয়া তথ্য মতে, একটি কমিটির মাধ্যমে মেলাটি পরিচালনা করা হয়। গ্রামের জনসাধারণের সম্মতিতে গঠন করা হয় সেই কমিটি। মেলা থেকে উপার্জিত আয় ব্যয় করা হয় গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্যানে, গ্রামের মানুষের ট্যাক্স পরিশোধে ও অন্যান্য সেবামূলক কাজে। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম (৩৫) বলেন, তিন-চার বছর থেকে মেলার জমজমাট অবস্থা নাই। পূর্বে লোকজনের ভিড়ে যাওয়া যেত না। মেলা উপলক্ষে নদীতে নৌকাবাইচ হতো। সেটা দেখতে হাজার হাজার মানুষ আসতেন।

কিন্তু নদীর নাব্যতা নেই, কচুরিপানায় ভরে গেছে, এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সুইসগেইট নির্মাণের ফলে এখন আর নৌকাবাইচ হয়না। ফলে মেলাতে লোক সমাগম অনেক কম হয়।

মেলার অতীত পরিসর বর্ণনা করতে গিয়ে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আফজাল হোসেন ও গ্রামবাসী বলেন, নদীর পাড়ের বড় একটি এলাকা নিয়ে মেলা বসতো। মেলা উপলক্ষে ১৭০টির অধিক গরু-মহিষ জবাই করা হতো। আত্মীয়- স্বজনে ভরে থাকতো বাড়ি। পুরো এলাকায় চলতো খাওয়া-দাওয়ার মহোৎসব। কিন্তু বর্তমানে ৫ থেকে ৭টি গরু-মহিষ জবাই করা হয়। আগের মত আর উৎসবমূখর নেই মেলার পরিবেশ।

অতীতে এতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ, সার্কাস, যাত্রা, পুতুল নাচ, যাদু প্রদর্শন, মটর সাইকেল খেলা-সহ বিভিন্ন চমকপ্রদ আয়োজন মেলাকে প্রাণবন্ত করে তুলতো। মেলার বিশেষ খাবার মিষ্টান্ন। ঝিলাপী, সন্দেশ, চমচম ও বিভিন্ন রকমের মিষ্টি। এবছর সেগুলোর দোকানপাট খুবই কম সংখ্যক পরিলক্ষিত হয়েছে।

এছাড়াও বাচ্চাদের খেলনাসহ বাহারী মাটির হাড়িপাতিল ছিল এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। মাটির তৈরী বাহারী নকশা করা ‘শখের হাড়ি’র সারি সারি দোকান আর চোখে পড়ে না। অতীতে মেলায় এসে মিষ্টান্ন কিনে হাড়ির ভেতরে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন দর্শনার্থীরা। নানারকম বাঁশি, খেলনা ও মাটির তৈরী বিশেষ এক ধরনের ‘ব্যাঙ গাড়ি’ নিয়ে ঘরে ফিরতো শিশুরা। কমমূল্যের এই গাড়িটি কমবেশি সব শিশুই কিনতো। এখন আর এগুলো চোখে পড়ে না। মেলায় চোখ জুড়ানো খোদাই করা কাঠের বিভিন্ন আসবাব পত্রে ভরে যায় স্কুল মাঠ। অন্যান্য বছরের তুলনায় সেই সংখ্যাও অত্যন্ত নগন্য।
বর্তমানে প্রসাধনী ও প্লাস্টিক খেলনার দোকানই মেলার মূল আয়োজন। মেলার দোকানী আব্দুস সালাম ও মো. লালু বলেন, প্রায় দুই যুগ থেকে প্রতি বছর এই মেলাতে ব্যবসা করে আসতেছি। আমাদের থাকা খাওয়ার সমস্যা হলেও কেনাবেচা ভাল হলে কষ্ট মনে হয় না। তবে কয়েক বছর ধরে ব্যবসা নাই। তার উপর এবছর করোনাতে মেলা আর মেলার মত নাই। 

উপজেলার পাঁচুবাড়ী গ্রাম থেকে মেলায় ঘুরতে এসেছিলেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই এই মেলাতে আমরা হরেকরকম জিনিস দেখি। কয়েকবছর থেকে আসা হয়না। আজকে আবার ছোটবেলার
দিনগুলো যেন ফিরে পেলাম।

তবে অতীতের মত মেলা আর জাকজমকপূর্ণ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে সার্কাস হতো, নৌকাবাইচ হতো, সেগুলো এখন নাই। অনেক মিস করছি। সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে আবারও মেলার হারানো রূপ ফিরিয়ে
আনা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই দর্শনার্থী।

মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি কলেজ শিক্ষক আনোয়ার হোসেন শেখ বলেন, অতীতে দীর্ঘদিন চলতো মেলাটি। মেলায় সার্কাস, গান-বাজনা হতো। কয়েক বছর থেকে ৭-৮ দিন স্থায়ী হয় মেলাটি। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার মাত্র দিন দুয়েক চলেছে মেলাটি। ২০১১ সাল পর্যন্ত জাকজমকপূর্ণভাবে মেলা চলেছে। কিন্তু তারপর থেকে ঝিমিয়ে পড়েছে।

কিসমত গণকৈড় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আফসার আলী মোল্লা বলেন, প্রতিবছরেই আশ্বিন মাসের শেষ তারিখে মেলা বসে, কোনরকম ঘোষণা ও মাইকিং ছাড়াই। পূর্বে মেলা উপলক্ষে আয়চাঁন নদীতে নৌকাবাইচ হতো।
নৌকায় প্রচুর মানুষ আসতো। এখন আর মানুষ নৌকাতে আসে না। আগের মত দোকানপাট নেই। মেলার অবস্থা করোনার মতই। মেলা দীর্ঘদিন চলে কিন্তু এবছর প্রায় দুই দিনেই মেলা শেষ হয়েছে।

আরপি/এসআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top