রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণের প্রতিবাদে রাজশাহীতে বিক্ষোভ, চলছে লাগাতার কর্মসূচি


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০২০ ০৩:৩৩

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৭:৩০

মানববন্ধন কর্মসূচী। ছবি: রাজশাহী পোস্ট

নোয়াখালী, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে কয়েক দিন থেকেই উত্তাল রাজশাহী। লাগাতার কর্মসূচি পালন করছে সাধারণ শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা।

এরই ধারাবাহিকতায় শনিবারও (১০ অক্টোবর) বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। চতুর্থদিনের মত রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। সকালে নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে তারা গণস্বাক্ষর কার্যক্রম পরিচালনা করে।
এছাড়াও সকালে একইস্থানে মানববন্ধন করেছে নারী মুক্তি সংসদ। রাজশাহী জেলা শাখার আয়োজনে মানববন্ধনে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

এতে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক দেবাশিষ প্রমানিক দেবু। সভাপতিত্ব করেন নারী মুক্তি সংসদের জেলা শাখার সভাপতি তসলিমা খাতুন। তারা দেশজুড়ে ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন।

দেবাশিষ প্রামানিক দেবু বলেন, সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কোন জায়গা আর নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। তিনি বলেন, ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু অনেক সময় আমরা সেটা দেখছি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এই বক্তব্য অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী যদি এই ধরণের বক্তব্য দেন তাহলে ধর্ষকেরা আরও উৎসাহিত হবে।

মানববন্ধনে নারীনেত্রী তসলিমা খাতুন বলেন, পোশাক কখনও ধর্ষণের কারণ হতে পারে না। পোশাকই যদি মূল বিষয় হতো তাহলে ৫ বছরের শিশুরা ধর্ষণের শিকার হতো না। সারাদেশে অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ধর্ষকেরা শাস্তি পাচ্ছে না। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত নারী মুক্তি সংসদ মাঠে থাকবে।

মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকমণ্ডলির সদস্য নাজমুল করিম অপু। সংহতি প্রকাশ করে আরও বক্তব্য দেন- মহানগর যুবমৈত্রীর সভাপতি মনিরুজ্জামান মনি, মহিলা পরিষদের জেলার সাধারণ সম্পাদক অঞ্জনা সরকার প্রমূখ।

কর্মসূচিতে নারী মুক্তি সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শারমীন আক্তার, আসমা বেগমসহ আরও অনেক নারী অংশ নেন।

এছাড়াও বিকেল ৪টায় সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ‘প্রতিবাদী মানববন্ধন’ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী সহ-সভাপতি নারীনেত্রী কল্পনা রায়ের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামার উল্লাহ সরকার প্রমূখ।

এর আগে গত মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) সর্বপ্রথম ধর্ষকদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবিতে রাজশাহীতে প্রতিবাদী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচির আয়োজন করে সাধারণ শিক্ষার্থী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে মানববন্ধন ও বিক্ষোভে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।

সেখানে শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো, ধর্ষণের বিচারের জন্য দ্রুত আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন, সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে যে কোন ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড এবং গণধর্ষণ এর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ফাঁসি, ১৮ বছরের নিচে কোন কিশোরী ধর্ষিত হলে তার পড়াশোনা, চিকিৎসাসহ সকল দায়ভার রাষ্ট্রের গ্রহণ, ধর্ষণ মামলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিস্পত্তি, ধর্ষণকে জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা, তিন মাসের মধ্যে আগে সংগঠিত সকল ধর্ষণ মামলার বিচারের কাজ নিস্পত্তি এবং ধর্ষণ মামলায় প্রশাসনের কারও স্বজনপ্রীতি, গাফিলতি ধরা পড়লে অথবা টাকা নিয়ে নিষ্পত্তি করতে চাইলে বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। এসব দাবি আদায় না হলে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।

ঐদিনই (৬ অক্টোবর) বিকেল ৪টায় নগরীর ভুবন মোহন পার্ক শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী "প্রতিবাদী অবস্থান" কর্মসূচী পালন করে। বিশিষ্ট আবৃতি শিল্পী মনিরা রহমান মিঠির সভাপতিত্বে এবং মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মহিলা পরিষদ- রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক অঞ্জনা সরকার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী এর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ, বাংলাদেশের কলেজ শিক্ষক সমিতি রাজশাহী জেলার সভাপতি রাজকুমার সরকার, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামার উল্লাহ সরকার, ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ডাঃ এফ এম এ জাহিদ, বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী তাপস মজুমদার।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী থিয়েটারের সভাপতি নিতাই কুমার সরকার, হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সলোক হোসেন, ধ্রুবসখার সভাপতি মনিরুল হক সন্টু-সহ আরো অনেকে।

পরের দিন বুধবার (৭ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে সাহেব বাজার জিরোপেয়েন্টে ধর্ষণবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঘণ্টাব্যাপি মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। এরপর জিরোপয়েন্ট থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে নগরীর সাহেব বাজার হয়ে মনিচত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে আবারও একই স্থানে এসে শেষ হয়। পরে জিরোপয়েন্টে শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে গণঅবস্থান ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করে।

গণঅবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিলে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ধর্ষণবিরোধী নানা স্লোগান দেন।

বৃহস্পতিবারেও (৮ অক্টোবর) গণস্বাক্ষর ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে শুক্রবার (৯ অক্টোবর) কোন কর্মসূচি পালন করতে পারেনি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পুলিশি বাঁধায় পণ্ড হয়ে গেছে তাদের ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ। ঐদিন দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে সমাবেশ করতে চেয়েছিলেন।

এ জন্য সকালে বেশ কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী সাহেববাজার বড় মসজিদের সামতে জড়ো হতে শুরু করেন। তখন নগরীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারন চন্দ্র বর্মনসহ পুলিশের একটি দল তাদের বাধা দেয়। পুলিশের বাধার মুখে পড়ে শিক্ষার্থীরা সমাবেশ না করে ফিরে যান।

এদিকে শুক্রবার (৯ অক্টোবর) শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে পুলিশের পাহারায় বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে বিভিন্ন ইসলামী দলগুলো। এসব কর্মসূচি থেকে স্লোগানে স্লোগানে ধর্ষকদের বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে।

জুমার নামাজের পর সাহেরবাজার বড় মসজিদ প্রাঙ্গন থেকে দুটি মিছিল বের করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং সর্বস্তরের ইমাম ও ওলামা মাশায়েখ। ধর্ষণবিরোধী নানা কথা লেখা ব্যানার- ফেস্টুন নিয়ে মিছিল দুটি নগরীর প্রধান সড়ক প্রদিক্ষণ শেষে একই স্থানে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

মিছিলের আগে থেকে পাহারা দেয় পুলিশ। মিছিলে নেতৃত্ব দেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজশাহী নগর শাখার সভাপতি শফিকুল ইসলাম।

বক্তব্য দেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা তাজুল ইসলাম, ফয়সাল হোসেন মনি, তারিফ উদ্দীন, বোরহান উদ্দীন, মরসেদ আলম, ছাত্রনেতা জহিরুল ইসলাম প্রমূখ। সমাবেশ থেকে বক্তরা বলেন, দেশে আজ যে ভাবে অপরাধ বেড়েছে, এটা মেনা নেওয়া যায় না। অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ধর্ষক, হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হলে তারা অপরাধ করতে ভয় পেতো।

তারা আরও বলেন, আমরা চাই ধর্ষকদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিলো মানুষ তার অধিকার, ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকবে। অপরাধী যে হোক না কেন, সে শাস্তি পাবে। তারা আরও বলেন, এখনও নারীর স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী নারী, এর পরেও দেশের নারীরা আজ শঙ্কিত। নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে। এটা মেনে নেয়া যায় না।

এছাড়াও একই দিনে (৯ অক্টোবর) দেশব্যাপী ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে নগ্ন পদযাত্রা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ খান। শুক্রবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে তিনি এই নগ্ন পদযাত্রা শুরু করেন।


তার এই নগ্ন পদযাত্রা নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে আধাঘন্টা অবস্থান নিয়ে তিনি সচেতনতামূলক বার্তা দেন। অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, আমরা চাই ধর্ষণমুক্ত একটি সমাজ। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এটি সম্ভব নয়। নারীদের প্রতি সম্মান জানাতেই আমার এই নগ্ন পদযাত্রা। 

 

আরপি/ এএন-০৩



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top