রাজশাহী বুধবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৫, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩২

গোদাগাড়ী মহাসড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ, চলতি বছরে ২৫ জনের মৃত্যু


প্রকাশিত:
১৯ জুন ২০২০ ১৯:৪৩

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৩৬

 

রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে অতি সাধারণ বিষয় ব্যাপার হয়ে পড়েছে। হালকা বৃষ্টি হলেই রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রতিদিন টিভি, পত্র-পত্রিকা, স্যোসাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চোখে পড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার মত অনাকাঙ্খিত বিষয়। অনেকেই বলেন, সড়ক নয় যেন মৃত্যুফাঁদ।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং রাজশাহী জেলা পুলিশ দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে গাড়ীর গতি কমানোর জন্য সাইনবোর্ড লাগালেও এর কোন উপকারিতা মিলছে না। রাস্তা সংস্করণের পর থেকেই এ সড়কে দুর্ঘটনা বেশী ঘটছে। এতে জনসাধরণের মনে প্রশ্ন জাগছে রাস্তা নির্মাণে কোন ত্রুটি আছে কি ? কারণ সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা হয়ে যাচ্ছে অতিমাত্রায় পিচ্ছিল। আবার রোদ বেশি হলেও পিচ গলে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। ঐ সময় রাস্তায় যানবাহনগুলো দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে বেশি।

গোদাগাড়ী ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, এ সড়কে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ৯ জন। আর শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই ৪ শিশুসহ ১২জনের মৃত্যু হয়। এসব দুর্ঘটনায় আরো অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া গোদাগাড়ী এলাকায় ৬ মাসে ৩০ টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। সবশেষ গত ১৩ জুন গোদাগাড়ীতে হালকা বৃষ্টির সময় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই বিজিবি সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরো ৪ জন আহত হন।

রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের সারাংপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত বিজিবি সদস্যরা হলেন ল্যান্স নায়েক জুবায়ের (৩৪) ও ল্যান্স নায়েক আবু সাঈদ (৩৫) তারা বিজিবি ৫৩ ব্যাটালিয়নের সদস্য। রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কটি গোদাগাড়ী উপজেলার উপর দিয়ে দুই জেলার যোগাযোগ পথ। বৃষ্টি ছাড়াও মহাসড়কের দু'পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝোপ ঝাড়ও এসব সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।

জানা যায়, এ বছরের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ১ মার্চ। এদিন একটি প্রাইভেট কার বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের গোদাগাড়ী থানাধীন কাদিপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার পাশে উল্টে যায়। এতে মাইক্রোচালকসহ একই পরিবারের ৬ জনসহ ৭ জন নিহত হন।
গোদাগাড়ী ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন মাস্টার আতাউর রহমান বলেন, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনা তার আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আর এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকেই। এমনকি মৃত্যুর হারও বেড়েই চলেছে। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৫ জন। আতাউর রহমান বলেন, বৃষ্টি হলেই সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়।

এছাড়া, উপজেলায় মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ৪০ টিরও বেশী। আমাদের অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা,ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ চালক, যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত চলাচল, ওভারটেকিং, সিগন্যাল তোয়াক্কা না করাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার হালকা বৃষ্টিসহ বিভিন্ন উৎসব যেমন ঈদ, পূজা বা কোনো দিবসেও সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা অনেকগুন বেড়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকারী সভাপতি ওলিউল্লাহ জিয়া বলেছেন, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে অটো, ভুটভুটি মহাসড়কে চলাচল, রাস্তায় খড়, ফসল শুকানো, অপরিকল্পিতভাবে ট্রাকে মাটি বা বালু উত্তোলনের সময় সড়কে পড়ে যাওয়ায় রাস্তা ব্যবহার উপযোগী না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশী ঘটছে। এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক বাস, ট্রাক, অটো বা মটর সাইকেল চালকের জন্যও দুর্ঘটনা বেশী হচ্ছে। রাস্তা নির্মানে কোন গাফিলতি আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে গোদাগাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, এসব বিষয়ে থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। এছাড়া গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও গাড়ি ড্রাইভারদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়েছে। গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করে রাখা ও ওভারটেকিং বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি। রাজশাহী-গোদাগাড়ী সড়কে পুলিশের কয়েকটি চেকপোস্ট রয়েছে। সেখানে গাড়ির কাগজপত্র দেখা হয়। এই চেকপোস্টগুলোতে যানবাহনের সিট ক্যাপাসিটি (বসার ধারণ ক্ষমতা) দেখা হবে। প্রয়োজনে মামলাও দেয়া হবে। সব মিলে ট্রাফিক আইন মেনে চললে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। এ সড়কে দুর্ঘটনা রোধে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এ সড়কটি যৌথভাবে মহানগর ও জেলা পুলিশের মধ্যে পড়ে। সেক্ষেত্রে আমরা যৌথ ভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকি। তবে স্পিড ব্রেকার বসানো বা গাড়ির স্পিড টেস্টের বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগ দেখাশোনা করে।

গোদাগাড়ী উপজেলা প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহামদ বলেন, গত কয়েকদিনে গোদাগাড়ী মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেশী হওয়ার কারণ হল সুন্দর রাস্তা। রাস্তা ভাল হওয়ায় সকলে গাড়ী দ্রুতগতিতে চালাচ্ছে। বেশী তাপমাত্রায় পিচ গলে যাওয়া প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাস্তা তৈরীর সময় বিটুমিন বেশী হওয়ায় এমন হচ্ছে। ফলে গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ সঠিক ভাবে না হতে পারে। তবে বিটুমিন কম হলে রাস্তার স্থায়ীত্ব কম হবে। রাস্তা পিচ্ছিল দূর করতে হলে মহাসড়কে ডাবল বিটুমিনার সার্ফেসিটি টির্টমেন্ট (ডিবিএসটি) অর্থাৎ রাস্তার উপরে হালকা উচু উচু পাথর বসালে পিচ্ছিল কমবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলমগীর হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের নির্দেশে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সামসুজ্জোহা, গোদাগাড়ী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ খাইরুল ইসলাম ও বিআরটিএ এর একজন প্রতিনিধিসহ কয়েকজন নিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে পরিদর্শন করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাথে আলোচনা করে দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় যা করা দরকার তা করতে হবে।

রাজশাহী জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সামসুজ্জোহা বলেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উপর মহলে কথা বলেছি এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পূর্বের দূর্ঘটনার পরিপেক্ষিতে সতর্কীকরণ বোর্ড স্থাপন করেছি। তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। কারণ ঘুমন্ত চালক, অপ্রাপ্তবয়স্ক হেলপার দিয়ে গাড়ী চালালো, অসাবধানতা, দীর্ঘ সময় ধরে ড্রাইভিং করা, ফিটনেশ বিহীন গাড়ী সড়কে চলাচলের করণে রোধ হচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ডাবল বিটুমিনার সার্ফেসিটি টির্টমেন্ট (ডিবিএসটি) করার বিষয়ে বলা হলে তিনি বলেন, এটা নতুন রাস্তায় তৈরীর নিয়ম নাই বা অনুমোদন দিবে না মন্ত্রনালয়, এটা তৈরী করা হয় ২-৩ বছরের পুরাতন রাস্তায়। তাই এটা এখনই সম্ভব নয় । তবে রাস্তা নির্মাণে আমাদের কোন ঘাটতি নাই।

 

আরপি/এমও-০২



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top