মোহনপুরে খাদ্য সংকটে ঘরবন্দি মানুষ

বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে পুরো পৃথিবীর মানুষের অবস্থান এখন ঘরে। প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিস্কার না হওয়ায় এ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ঘরে থাকা, আর সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা। জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও সেনাবাহিনী সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে ও বিনা কারণে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্য অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। কেউ কেউ করোনা থেকে বাঁচতে প্রাণপন লড়াই করে চলেছেন। কোভিড-১৯ ছোয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব বন্ধে হাট বাজার, রাস্তাঘাটসহ পুরো এলাকা অবরুদ্ধ হওয়ায় রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে নিরবে নিভৃতে হাহাকার করছেন।
গত ২৮ মার্চ হতে সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকা কর্মহীন মানুষের মাঝে অর্থ সংকট ও খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার যতটুকু অর্থ ও খাদ্য ছিলে তা ব্যবহার করে শেষ করেছেন। ১ মাস যাবত কোন কাজ না থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা পড়েছেন চরম বেকায়দায়।
গরিবেরা পাচ্ছে ত্রাণ, আর মধ্যবিত্তরা না খেয়ে মুছছে চোখের পানি, কারো কাছে চাইতে না পারেনা বলে মধ্যবিত্তদের পাশে নেই কেউ। নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য তুলে দিচ্ছেন অনেকেই, সরকারও গরীব ও নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে মধ্যবিত্তদের পাশে নেই কেউ! ঘরে খাবার না থাকলেও মধ্যবিত্তরা লজ্জায় কিছুই বলতে পারছে না। উপজেলায় হাজার হাজার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থাও প্রায় একই।
এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে করোনা নয় ক্ষুধার জালায় রাস্তায় নামতে হবে তাদের। অবশ্য গত ৩/৪ দিন যাবত উপজেলার রাস্তাঘাট ও হাট বাজারে সাধারণ মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। তাদের সচেতন করতে ও করোনা সংক্রমণরোধে প্রশাসনের সচেতনামুলক কোন কর্মসূচীই যেন কাজে আসছে না। অবরুদ্ধ থাকা মানুষগুলো করোনা সংক্রমনের ঝুকি আছে জেনেও অর্থ ও খাদ্যের প্রয়োজনে বের হতে শুরু করেছে।
কোভিড-১৯ দিন দিন ধ্বংসাত্বক রুপ ধারণ করায় কর্মহীন হাজার হাজার মানুষগুলির জীবনযাত্রা দিন দিন খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। একদিকে করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তা অন্যদিকে পরিবারে নেই খাবার । এ যেন প্রকৃতির এক চরম রসিকতা। এদিকে করোনার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত ও রমজানের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের দাম বাড়ায় মরার উপর খাড়ার ঘাঁ তৈরী হয়েছে। দিনের পর দিন অবরুদ্ধ মানুষগুলো একসাথে এতগুলো সমস্যা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মধ্য দিন দিন বাড়ছে হতাশা। উপজেলার ৬ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় ৪৯ হাজার পরিবারে ১ লাখ ৭৩ হাজার জনগণের বাস।
উপজেলায় সরকারী সাহয্যের পাশাপাশি কেশরহাট পৌর মেয়র শহিদুজ্জামান, মোহনপুর থানা পুলিশ, সামাজিক সংগঠণ শাপলা গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, শতফুল বাংলাদেশ, রুপসী পল্লী বাংলাদেশ (আরপিবি) ও ব্যক্তি উদ্যেগে রহমান হোন্ডাসহ হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি ঘরে থাকা নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। তবে এখনও ত্রাণ পাননি মধ্যবিত্তরা। কিছু কিছু এলাকায় বার বার ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে একই পরিবার ও গোষ্ঠীরা ত্রাণ পাওয়ায় জনগণের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে।
এদিকে, মোহনপুর ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার বিপুল কুমার মালাকার জানান, এ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণরোধে ঘরবন্দী ৫ হাজার ৫১৪ পরিবারের মাঝে ৫৫ দশমিক ১৪ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ২ লাখ টাকা মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা একে এম ফজলুল হক জানান, উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় জনগণের মাঝে ১০ টাকা কেজিতে ৬ হাজার ৭৪২ জন কার্ডধারীদের মাঝে ৩০ কেজি চাল বিক্রয় করা হয়েছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ডিলার আবুল হোসেন জানান, সপ্তাহে ৩ দিন জনগণের মাঝে ন্যায্যমূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি, ছোলা, মশুর ডাল, খেজুর বিক্রয় করা হচ্ছে। প্রতিদিন তেল ২০০ জন, চিনি ৩৫০ জন, ছোলা ৪০০ জন, মশুর ডাল ২০০ জন এবং খেজুর ২৪০ জনের মানুষের মাঝে বিক্রয় করা হয় এবং তা চলমান আছে বলে জানা গেছে।
সরকারী বেসরকারি এসব সুযোগ সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর কিছুদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে ঘরবন্দী মানুষেরা চরম খাদ্য সংকটে পড়বে। এ অবস্থায় উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি থাকলেও কিছু লোক বাদে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।
ঘরে আবদ্ধ কর্মহীন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের পাশে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে ও খোলা বাজারে ওএমএস চাল বিক্রয় করা হলে এ সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
ধুরইল বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী হালিমের হোটেল ব্যবসা ভালোই চলত। তার দোকান ৮ জন কর্মচারী ও ২ ছেলে ১ মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে পরিবারে ছিলনা কোন অভাব। হোটেল থেকে যে আয় হতো সেটি দিয়েই ভালোভাবে চলতো তার সংসার। কিন্তু তার কোনো সঞ্চয় নেই অনেকদিন যাবত ব্যবসা করলেও এমন সংকটে কখনোই পড়তে হয়নি তাকে। প্রায় ১ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে তার হোটেল ব্যবসা। হাতে কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে সপ্তাহখানেকের বাজার করেছিলেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। কিভাবে দোকান ভাড়া দেবেন কিভাবে সংসার চালাবেন সেই চিন্তা এখন তার চোখে মুখে এমন কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারছেন না তিনি।
কথা হয় বই ও ফটোকপি ব্যবসায়ী আলমের সাথে। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, এটা কোন জীবন হল! সংসার চালাতে সব সময় সংগ্রাম করতে হয়। আমাদের এখন রীতিমতো যুদ্ধ করে জীবন বাঁচাতে হচ্ছে। চক্ষুলজ্জায় কষ্টগুলো প্রকাশ করতে পারছিনা কারো সামনেই। ওই যে ‘ আমরা মধ্যবিত্ত ’, আমাদের কোন কষ্ট নেই, আছে শুধু সুখ। কিন্তু এর আন্তড়ালে আমরা যে কত কষ্টে জীবনযাপন করি তা বোঝেনা কেউ। বোঝারও চেষ্টাও করে না। প্রধানমন্ত্রী মধ্যবিত্তদের তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ নেয়নি। আল্লাহর আমাদের একমাত্র ভরসা।
ধুরইল গ্রামের গৃহিনী ফরিদা বেগম বলেন, আমার স্বামী কিছুদিন আগে মারা গেছেন। আমার মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। এমনিতে অভাবের সংসার তার উপর করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বের হতে পারছিনা এ পর্যন্ত কোন কেউ আমার পরিবারে সহযোগিতা করেনি। সরকারীভাবে কিছু সহযোগীতা পেলে বড়ই উপকার হতো ।
ত্রাণ বিতরণ বিষয়ে সামাজিক সংগঠণ রুপসী পল্লী বাংলাদেশ (আরপিবি)’র প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমরা করোনা সংক্রমন ও প্রতিরোধে ঘরে অবরুদ্ধ মোহনপুর ও পবা উপজেলার ৩ হাজার মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি এবং তা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে হাট বাজার লকডাউন থাকায় কৃষকরা তার উৎপাদিত সবজি বিক্রয় করতে পারছেনা। কৃষি বাঁচলে বাঁচবে দেশ। সেজন্য কৃষকের কথা চিন্তা করে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কৃষকের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরণের সবজি কিনে আমরা ঘর অবরুদ্ধ মানুষের মাঝে বিতরণ করছি। যতদিন করোনা প্রাদুর্ভাব থাকবে ততদিন আমাদের এ কার্যক্রম চালিয়ে যাব।
আরপি/এএন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: