দোয়া কুনুতে আল্লাহর কাছে আমরা কি প্রার্থনা করি?
দোয়া কুনুত একটি মূল্যবান দোয়া। ‘কুনুত’ অনেক অর্থসমৃদ্ধ একটি শব্দ। এ শব্দ দ্বারা নীরবতা, সালাত, কিয়াম, ইবাদত ইত্যাদি বুঝায়। এখানে কুনুত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- ‘নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় আল্লাহর কাছে দোয়া করা।’ এশার পর বিতির নামাজের তৃতীয় রাকাতে সুরা ফাতেহার সঙ্গে অন্য সুরা মিলানোর পর এটি পাঠ করতে হয়। এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ আবেদনগুলো তুলে ধরা হয়। রাসুল (স.) দোয়া কুনুত পাঠ করতেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি একরাতে নবী (স.)-এর নিকটে ছিলাম। তিনি শয্যাত্যাগ করলেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। এরপর উঠে বিতর পড়লেন। প্রথম রাকাতে ফাতেহার পর সুরা আ’লা পাঠ করলেন। এরপর রুকু ও সেজদা করলেন। দ্বিতীয় রাকাতে ফাতেহা ও কাফিরুন পাঠ করলেন এবং রুকু-সেজদা করলেন। তৃতীয় রাকাতে ফাতেহা ও ইখলাস পাঠ করলেন। এরপর রুকুর আগে কুনুত পড়লেন।’ (কিতাবুল হুজ্জাহ: ১/২০১; নাসবুর রায়াহ: ২/১২৪)
দোয়া কুনুতে আমরা আল্লাহর ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহর ওপর ঈমান ও তাঁরই ওপর ভরসা রাখার সাক্ষ্য প্রদান করি। সকল মঙ্গল আল্লাহর হাতে ন্যস্ত—এ কথার স্বীকারোক্তি প্রদানমূলক তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় ও তাঁরই দাস হিসেবে চলার তাওফিক কামনা করি। আল্লাহ যেন আমার মতো মুমিন দাসকে আজাবমুক্ত রাখেন সেই দোয়া করি এবং তাঁর রহমত কামনা করি।
দোয়া কুনুত আরবি
اللّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِيْ عَلَيْكَ الْخَيْرَ وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَّفْجُرُكَ، اللّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّيْ وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعٰى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشٰى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ
দোয়া কুনুতের উচ্চারণ
আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতায়িনুকা ওয়া নাসতাগ ফিরুকা, ওয়ানু’মিনু বিকা ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা ওয়া নুছনি আলাইকাল খাইর। ওয়া নাশকুরুকা ওয়ালা নাকফুরুকা, ওয়ানাখলাউ উয়ানাতরুকু মাইয়্যাফযুরুকা। আল্লাহুম্মা ইয়্যাকানা’বুদু ওয়ালাকা নুছল্লি, ওয়ানাসজুদু ওয়া ইলাইকা নাসআ; ওয়া নাহফিদু ওয়া নারজু রাহমাতাকা, ওয়া নাখশা আজা-বাকা; ইন্না আজা-বাকা বিলকুফফা-রি মুলহিক।
দোয়া কুনুতের অর্থ
হে আল্লাহ! আমরা আপনারই সাহায্য চাই। আপনারই নিকট ক্ষমা চাই, আপনার প্রতি ঈমান রাখি, আপনারই ওপর ভরসা করি এবং সকল মঙ্গল আপনার দিকেই ন্যস্ত করি। আমরা আপনার কৃতজ্ঞ হয়ে চলি, অকৃতজ্ঞ হই না। হে আল্লাহ! আমরা আপনারই দাসত্ব করি, আপনারই জন্য নামাজ পড়ি এবং আপনাকেই সেজদা করি। আমরা আপনারই দিকে দৌড়াই ও এগিয়ে চলি। আমরা আপনারই রহমত আশা করি এবং আপনার আজাবকে ভয় করি। আর আপনার আজাব তো কাফেরদের জন্যই র্নিধারিত।
দোয়া কুনুতে আরও যেসব দোয়া পড়া যায়
কোরআনের যেসব আয়াতে দোয়া আছে, সেসব আয়াত পড়া ও সেগুলো দিয়ে কুনুত করা জায়েজ হবে। যেমন- আল্লাহ তাআলার বাণী—رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ ‘রব্বানা লা-তুযিগ ক্বুলুবানা বা’দা ইজ হাদাইতানা, ওয়াহাব লানা মিন লাদুনকা রাহমাতান, ইন্নাকা আন্তাল ওয়াহ্যাব। অর্থ: হে আমাদের রব্ব! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনে প্রবৃত্ত করবেন না এবং আপনি আমাদের অনুগ্রহ করুন। আপনিই সব কিছুর দাতা। (সুরা আলে ইমরান: ৮)
এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.)- আল হাসান বিন আলী (রা.)-কে বিতির নামাজের কুনুতে পড়ার জন্য নিম্নলিখিত দোয়াটি শিখিয়ে দিয়েছেন। তাই কুনুতে এই দোয়া পড়া উত্তম। দোয়াটি হলো—
اَللَّهُمَّ اهْدِنِيْ فِيْمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنِيْ فِيْمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنِيْ فِيْمَنْ تَوَلَّيْتَ، وَبَارِكْ لِيْ فِيْمَا أَعْطَيْتَ، وَقِنِيْ شَرَّمَا قْضَيْتَ؛ إِنَّكَ تَقْضِىْ وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ، وَإنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَّالَيْتَ، وَلاَ يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ، تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! যাদেরকে তুমি হেদায়াত করেছো আমাকেও তাদের সঙ্গে হেদায়াত করো, যাদের প্রতি উদারতা দেখিয়েছ তাদের সঙ্গে আমার প্রতিও উদারতা দেখাও। তুমি যাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ তাদের সঙ্গে আমার অভিভাবকত্বও গ্রহণ করো। তুমি আমাকে যা দান করেছ তার মধ্যে বরকত দাও। তোমার নির্ধারিত খারাবি থেকে আমাকে রক্ষা কর। কেননা তুমিই নির্দেশ দিতে পার, তোমার উপর কারো নির্দেশ চলে না। যাকে তুমি বন্ধু ভেবেছ সে কখনও অপমানিত হয় না। তুমি কল্যাণময়, তুমি সুউচ্চ।’ আল হাসান বিন আলী (রা.) এই দোয়ার ব্যাপারে বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে কয়েকটি বাক্য শিখিয়ে দিয়েছেন। এগুলো আমি বিতরের নামাজে পাঠ করে থাকি।’ (তিরমিজি: ৪৬৪)
বিতিরের নামাজে দোয়ায়ে কুনুত হুবহু নবী (স.) থেকে বর্ণিত শব্দে হওয়া ওয়াজিব নয়। বরং মুসল্লি অন্য কোনো দোয়াও করতে পারেন। হাদিসের শব্দের বাইরে কিছু বাড়াতেও পারেন। এমনকি যদি কোরআনের যেসব আয়াতে দোয়া আছে, এমন কিছু আয়াত পড়েন— সেটাও জায়েজ আছে। ইমাম নববী বলেন, জেনে রাখুন- অগ্রগণ্য মাজহাবমতে, কুনুতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। তাই যেকোনো দোয়া পড়লে কুনুত হয়ে যাবে; এমনকি দোয়া সম্বলিত এক বা একাধিক কোরআনের আয়াত পড়লেও কুনুতের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। তবে হাদিসে যে দোয়া এসেছে সেটা পড়া উত্তম। (ইমাম নববির ‘আল-আজাকার, পৃষ্ঠা-৫০)
দোয়া কুনুত হলো গভীর রাতে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একান্ত প্রেমালাপ। এ দোয়ার ফলে আল্লাহ বান্দার ওপর খুশি হন। বান্দার চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ করে দেন। দুনিয়ার সব বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি দেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে গভীর রাতে বিতির নামাজে দৃঢ়চিত্তে দোয়া কুনুতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরপি/এসআর-১২
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: