যে আট অবস্থায় ভাঙা যায় রোজা
রমজানের রোজা ফরজে আইন বা অবশ্য পালনীয়। কেউ শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া রোজা ছেড়ে দিলে ফাসিক ও কঠিন গুনাহগার হবেন। কাজা বা কাফফারা (শরিয়তের বিচারে যেটি তার ওপর বর্তায়) আদায় না করা পর্যন্ত তিনি দায়মুক্ত হবেন না। কাজা-কাফফারা আদায়ের মাধ্যমে দায়মুক্তি মেলে ঠিক, কিন্তু রমজানের রোজার বিপুল পরিমাণ সওয়াব ও ফজিলত থেকে ঠিকই বঞ্চিত থাকতে হয়।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শরয়ি কোনো ওজর ছাড়া রমজানের কোনো রোজা ভেঙ্গে ফেলবে, সারাজীবন রোজা রাখলেও সেই রমজানের রোজার সমপরিমাণ হবে না।’ (সহিহ বুখারি- শামেলা-৩/৪৩)
তবে কিছু কারণে ইসলামি শরিয়ত রোজা না রাখা বা ভেঙে ফেলার অনুমতি দিয়েছে। মহান আল্লাহ আসলে বান্দার জন্য সহজটাই চান, কঠিন চান না। তাই জীবনের ঝুঁকি থাকলে সেখানে বিধান মানা আর ওয়াজিব থাকে না। তখন ওয়াজিব হয়ে যায় জান বাঁচানো।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত ভার অর্পণ করেন না।’ (সুরা বাকারা: ২৮৬) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আল্লাহ দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি।’ (সুরা মায়েদা: ৬)
এখন আমরা দেখে নেবো, কোন অবস্থায় রোজা না রাখা বা ভেঙে ফেলার অবকাশ আছে।
১) অসুস্থতা যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, রোজা রাখার শক্তি নেই বা রোজা রাখলে বরং অসুস্থতা আরও বেড়ে যাবে, তাহলে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে হ্যাঁ, সুস্থ হওয়ার পরে ওই রোজা কাজা করে নেওয়া ওয়াজিব। (আপকে মাসায়েল: খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা-২০২)
২) ক্ষুধা বা পিপাসার কারণে প্রাণ চলে যাওয়ার উপক্রম হলে রোজা ভেঙে দেওয়া জায়েজ এবং এতে কাফফারা নয়, কাজা করলেই যথেষ্ট হবে। (আলমগিরি: খণ্ড. ১, পৃষ্ঠা-২০৭)
৩) একইভাবে রোজাদার যদি এমন দুর্বল হয়ে পড়েন যে, রোজা রাখার আর শক্তি নেই। (আপকে মাসায়েল: খণ্ড. ৩, পৃষ্ঠা-২০৩)
৪) রোজায় দুর্বলতার কারণে জীবনের প্রয়োজনীয় উপার্জন করা সম্ভব না হলে, তার জন্যও রোজা ভেঙে ফেলার অনুমতি রয়েছে। তবে তা পরে কাজা করে নিতে হবে। তা-ও সম্ভব না হলে ফিদিয়া আদায় করবে এবং প্রতি রোজার পরিবর্তে সদকায়ে ফিতর পরিমাণ দান করে ফিদিয়া আদায় করবে। (শামি: খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা-৪০০)
৫) গর্ভধারিণী বা স্তন্যদানকারিণী মহিলা যদি নিজের অথবা বাচ্চার প্রাণনাশের আশঙ্কা করেন, তাহলে তার জন্য রোজা ভেঙে ফেলা জায়েজ আছে। (আলমগিরি: খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা-২০৭)
৬) রোজা রাখার কারণে ফসল কর্তন করা যদি সম্ভব না হয় এবং দেরি হলে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে রোজা না রাখার অনুমতি আছে এবং অন্য সময় কাজা করে নেবে। (শামি: খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা-৪০০)
এখানে উল্লেখ্য, যাদের পেশাই হলো কঠিন কাজ। যেমন—পাথর কাটা বা কয়লা ইত্যাদির খনিতে যারা কাজ করে এবং যারা আজীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত, তারা রোজা রাখতে অস্বাভাবিক কষ্ট অনুভব করলে রোজা না রাখতে পারে। তবে তাদের জন্য (তাদের পরিবার দ্বারা) ফিদিয়া আদায় করা জরুরি। অবশ্য এ কাজ সম্ভব না হলে তাও তাদের জন্য মাফ। কারণ, ‘আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতীত ভার অর্পণ করেন না।’ (সুরা বাকারা: ২৮৬)
একইভাবে উট বা ছাগল-ভেড়ার রাখাল রৌদ্রে বা পিপাসায় যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে যতটুকু পরিমাণ পানাহার করা দরকার ততটুকু করে বাকি দিনটুকু সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকবে। অতঃপর রমজান বিদায় নিলে ওই দিনটি কাজা করে নেবে। আর এর জন্য কোনো কাফফারা নেই। (মাজাল্লাতুল বুহুসিল ইসলামিয়্যাহ: ২৪/৬৭, ১০০)
৭) মুসাফির রোজা না রাখাতে দোষ নেই। আবার সফররত অবস্থায় রোজা রাখা শুরু করলে তা আর ভাঙা জায়েজ হবে না। কিন্তু যদি পিপাসার কারণে প্রাণনাশের আশঙ্কা হয়, তাহলে রোজা ভাঙতে পারবে, পরে তা কাজা আদায় করবে। (ফতোয়া তাতারখানিয়া: ৩/৪০৩; রদ্দুল মুহতার: ২/৪৩১)
৮) অনিবার্য কারণবশত বা আপতিত বিপদের হাত থেকে বাঁচতে কখনো কখনো রোজা না রাখা বা ভেঙে ফেলা জরুরি হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় সেটির অবকাশ আছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে রোজা রেখে মক্কার উদ্দেশে সফর করেছিলাম। আমরা এক জায়গায় যাত্রাবিরতি দিলাম, তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের শত্রুর নিকটবর্তী হয়েছ। রোজা ভঙ্গ করাই তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবে।’ (সহিহ মুসলিম: ১১২০)
একইভাবে ডুবে যাওয়া বা আগুনে পোড়া ব্যক্তির চিকিৎসা রোজা ভঙ্গ না করলে করা সম্ভব হয় না। এমন ব্যক্তিও রোজা ভেঙে দেবেন এবং পরবর্তী সময়ে রোজা কাজা করবেন।
এখানে উল্লেখ্য, শরিয়তসম্মত কারণ বলতে মূলত সরাসরি জীবনের ঝুঁকি, অতিশয় দুর্বলতা এবং পুরোনো অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদিকে বোঝায়। এর বাইরে ঠুনকো কোনো কারণে রোজা ভেঙে দেওয়ার কোনো মাসয়ালা ফিকহের কিতাবে দেখা যায় না। যেমন পরীক্ষার সময় মেহনতি ছাত্রদের জন্য রোজা না রাখা বা ভেঙে দেওয়া বৈধ নয়। কারণ এটা শরয়ি ওজর নয়, যার জন্য রোজা কাজা করা বৈধ হতে পারে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রোজার যাবতীয় বিধান যথাযথ মেনে রমজানের বরকত ও কল্যাণ লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরপি/এসআর-০৯
বিষয়: রমজান মাস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: