রাজশাহী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ ক্ষেত্রে হয়রানির অভিযোগ

বিধি না মেনে ভবন নির্মাণ, নজরদারি নেই আরডিএ’র


প্রকাশিত:
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৯:০৬

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪৩

 

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) ভবন নির্মাণ নীতিমালা অমান্য করেই নগরীতে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত, শহরের ৮০-৯০ শতাংশ ভবনই পুরোপুরি বিধি মেনে নির্মাণ করা হয়নি।

কারন হিসেবে আরডিএ কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকাকে দুষছেন নগরবাসী। এছাড়াও অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কিছু বাড়ির মালিকদেরকে হয়রানির অভিযোগ সংশ্লিষ্ট এই দপ্তরের বিরুদ্ধে।

নগরীর উপশহর হাউজিং এস্টেটের ১ নম্বর সেক্টর ঘুরে দেখা যায়, পুরোনো বাড়িগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মে নির্মাণ করা হয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, বিগত ১০-১৫ বছর যাবত উপশহর হাউজিং এস্টেটের ১ নম্বর সেক্টরের বাড়িগুলোর মাঝে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে নির্মিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক বাড়ির মালিক দেড় ফুট করে জায়গা ছেড়ে বাড়ি নির্মাণ করে আসছেন। ফলে এই নিয়ম মেনেই এখানকার বাড়িগুলো তৈরী হয়েছে। আরডিএ’র নিরবতাই এটাকে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছে।

কেউ নতুনভাবে ভবন নির্মাণ করতে চায়লে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ সালের ৩ ধারা অনুযায়ী, বাড়ির পেছনে ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি ও বাড়ির উভয় পাশে ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি করে জায়গা ছাড়তে হবে। অর্থাৎ দুইটি বাড়ির মাঝে দূরত্ব থাকবে ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি। এবং ভবনের সম্মুখভাগে ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি জায়গা ছাড়া থাকতে হবে। কিন্তু বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনটাই ঠিকভাবে মানা হচ্ছে না।

নগরীর উপশহর হাউজিং এস্টেট ঘুরে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি নির্মাণের সময় চেষ্টা করা হয়েছে বিধিমালা পালনের। সেটাও পুরোপুরি নয়। হাউজিং এস্টেটের ১ নং সেক্টরে বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৬ শতাধিক। যেখানে প্রতিটি প্লটের প্রস্থ ২৫ ফুট ও দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট। জমির পরিমাণ পৌনে ২ কাঠার মত। এই বাড়িগুলোর মধ্যে ২৫০ থেকে ৩০০টি বাড়ি আরডিএ থেকে ইমারতের নকঁশা অনুমোদন গ্রহণ করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন, যার একটিও উল্লেখিত বিধি মোতাবেক নির্মিত হয়নি। এছাড়াও বাড়িগুলোর মাঝে ১ ফুটেরও কম দুরত্ব রয়েছে এমন অসংখ্য বাড়ি নজরে পড়ে।

এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, বিগত ১০-১৫ বছর যাবত উপশহর হাউজিং এস্টেটের ১ নম্বর সেক্টরের বাড়িগুলোর মাঝে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে নির্মিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক বাড়ির মালিক দেড় ফুট করে জায়গা ছেড়ে বাড়ি নির্মাণ করে আসছেন। ফলে এই নিয়ম মেনেই এখানকার বাড়িগুলো তৈরী হয়েছে। আরডিএ’র নিরবতাই এটাকে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছে।

আরও জানা যায়, যেহেতু ১ নম্বর সেক্টরের প্লটগুলোর জমির পরিমাণ পৌনে ২ কাঠার মত, সেহেতু পাশাপাশি বাড়ির মালিকরা সমঝোতার ভিত্তিতে বাড়িগুলি নির্মাণ করেন। প্রত্যেকেই দেড় ফুট করে ছেড়ে বাড়ি নির্মাণ করেন। এবং বাড়ির মালিকরাই বলতে গেলে এক ধরনের ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে দেড় ফুট জায়গা ছাড়া হচ্ছে কিনা তা তদারকি করেন। বর্তমানে একই নিয়ম মেনেই নতুনভাবে বেশ কিছু বাড়ির নির্মাণ চলছে। কিন্তু সেদিকে আরডিএ কর্তৃপক্ষের নজর নেই।

তবে অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কিছু বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে নোটিস প্রদান করছে আরডিএ কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগ তুলছেন এখানকার কিছু বাসিন্দা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাড়ির মালিক বলেন, দীর্ঘ দিনের সমঝোতার ভিত্তিতে বাড়ি নির্মাণের যে সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে যে ৩ শতাধিক বাড়ি দেড় ফুটের মত জায়গা ছেড়ে করা হয়েছে, সেইসব বাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না করে মুষ্টিমেয় কিছু বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে নোটিস জারি বা মামলা দায়ের করে হয়রানির মুখে ফেলবেন কেন? এতে কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে?- এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এ বিষয়ে ইমারত নির্মাণ কমিটির অথরাইজড অফিসার মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, আরডিএ কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্দিষ্টভাবে না জানালে ঠিক বলা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে, ইমারত বিধিমালা (বিল্ডিং কোড) লঙ্ঘনে আরডিএ দফতরে প্রায় প্রতিদিন অভিযোগপত্র জমা পড়ছে। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের কারণে আশপাশের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় একটার পর একটা অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। ফলে নগরীতে নকশাবহির্ভূত বহুতল ভবনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ভুক্তভোগী নগরবাসীদের অভিযোগ, পাঁচতলার অনুমোদন নিয়ে সাততলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সাততলার অনুমোদন নিয়ে ১০ তলা ভবনও বানানো হচ্ছে। ইমারত বিধিমালা উপেক্ষা করে সড়ক ঘেঁষে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবনের উচ্চতা অনুযায়ী রাস্তা ও ফাঁকা জায়গা ছাড়ার নির্দিষ্ট বিধি থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আরডিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো তদারকি নেই।

সম্প্রতি জানা গেছে, নগরীর লক্ষ্মীপুরে ১৩ তলার অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করছে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। মাটির নিচে তিনতলাসহ ১৩ তলা ভবনটির পাইলিং কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে। মূল ভবনের নির্মাণের সময় পাশের চৌরঙ্গী মসজিদ ভবন হেলে পড়েছে। ভবনটি পাশের সেঞ্চুরি আবাসিক হোটেল ভবন ও দুটি ভবনের গায়ে হেলে পড়েছে। নির্মাণাধীন পপুলার ভবনের পাশের তিনটি ভবনে ফাটল ধরায় সংশ্লিষ্ট ভবন মালিক ও মসজিদ কমিটি আরডিএ চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বরাবরও তারা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। পপুলার ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার আবেদন জানান তারা। কিন্তু দুই কর্তৃপক্ষ এখনও নীরব।

ক্ষতিগ্রস্ত সেঞ্চুরি হোটেলের মালিক আনোয়ার মোস্তফা বলেন, ইমারত বিধিমালা ভেঙে পপুলার কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণ করছেন। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে পাশের ভবন থেকে পাঁচ ফুট ফাঁকা জায়গা রেখে ভবন নির্মাণের কথা। কিন্তু পপুলার পাশের সবকটি ভবনের কোল ঘেঁষে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পাশের তিনটি ভবনে ছোটবড় অসংখ্য ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পাঁচতলা মসজিদ ভবনে ফাটলের কারণে সেখানে মুসল্লির সংখ্যা কমে গেছে। সেঞ্চুরি হোটেলে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জন বোর্ডার থাকেন। হোটেল ভবনের নিচে ৫০টি দোকান আছে। সেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষের আনাগোনা। এসব মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। সব জায়গায় অভিযোগ দিয়েও তারা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরডিএ’র অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইমারত বিধি মেনে চলার শর্তে পপুলারকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু পপুলার কর্তৃপক্ষ বিধি মানছে না বলেই প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর আরডিএ’র পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে সতর্কও করা হয়েছে। নিয়ম না মানলে তাদের ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়া হবে বলে তিনি জানান। পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হবে। তিনি জানান, মহানগরীতে নতুন নতুন বহুতল ভবন হচ্ছে। ইমারত বিধি লঙ্ঘনেরও অনেক অভিযোগ আসছে।

লক্ষ্মীপুর এলাকায় ২২ তলা ডক্টরস ভবন নির্মাণের সময় পাশের ভবনে ফাটল দেখা দেয়। এ কারণে ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। ভবন মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে এবং যথাযথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এখন তারা ভবন নির্মাণ করছেন। আলোচিত এ ভবন নির্মাণে আরডিএ’র কঠোর নজরদারি রয়েছে বলে তিনি জানান। পপুলারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোর্শেদ আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা ধরেননি।

পপুলার ভবন নির্মাণে ইমারত বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ সম্পর্কে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, বিষয়টি তাদের গোচরে রয়েছে। ইমারত বিশেষজ্ঞদের দিয়ে স্পট পরিদর্শন ও মতামত গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছি। কোথাও বিচ্যুতি হলে পপুলার ভবন নির্মাণ বন্ধ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ইমারত বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে আরডিএ ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে প্রতিদিন একাধিক লিখিত অভিযোগ জমা পড়ছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- রাস্তার জন্য জায়গা না ছেড়ে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ১০ ফুট সড়কের পাশে চার তলার জায়গায় সাত থেকে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।

অভিযোগ, তালাইমারীতে পুকুর ভরাট করে বাসভবন নির্মাণ করেছেন আরডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান বজলুর রহমান। প্রথমে তিনি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেন। পরে আরডিএ’র চেয়ারম্যান হলে আইন লঙ্ঘন করে তিনি ছয়তলার নকশা অনুমোদন করে নেন।

 

আরপি/ এএন



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top