রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১

নগরীতে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি কমাতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট


প্রকাশিত:
৯ জুন ২০২২ ০৯:১০

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪৮

ছবি: রাজশাহী পোস্ট

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। এই হাসপাতালকে ঘিরেই নগরীজুড়ে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিনিয়তই বাড়ছে বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালের সংখ্যা। এসব প্রতিষ্ঠানে দৈনিক চিকিৎসা নিচ্ছেন হাজার হাজার রোগী। ফলে নগরীজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণ।

২০০৮ সালের চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিতে বলা হয়, প্রতিটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশসম্মত উপায়ে চিকিৎসা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের নিশ্চয়তা প্রদানে আর্থিক ও আইনগতভাবে দায়ী থাকবে। কিন্তু কাগজে লেখা সেই বিধান বাস্তবে প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তাই বেসরকারি সংস্থা প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট।

তথ্যমতে, রাজশাহী নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ১০.৫ টন ক্ষতিকারক চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল হওয়ায় নগরীর জনজীবন রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাই পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) ও প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

২০২০ সালের পহেলা অক্টোবর রাজশাহী নগরীর অদূরে সিটি হাট এলাকায় কেন্দ্রীয় ডাম্পিং ইয়ার্ডের পাশে এই প্ল্যান্টের উদ্বোধন করেন রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিধি-২০০৮ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডব্লিউএইচও) বিধিমালার মৌলিক বিষয়সমূহ অনুসরণ করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে এসব মেডিকেল বর্জ্য।

ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে সরেজমিনে দেখা যায়, ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিশোধিত হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য। বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী সংগৃহীত বর্জ্য প্রথমেই আলাদা করছেন এক দল শ্রমিক। পরে অটোক্লেভিং, ইনসিনারেশন, ডিপ বারিয়াল ও রিসাইক্লিং ও ইটিপি প্রক্রিয়ায় চলছে পরিশোধন কার্যক্রম।

এর মধ্যে অটোক্লেভিং প্রক্রিয়ায় ১৩৫ থেকে ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ও ৩ বার বায়ুমণ্ডলীয় চাপে জিবাণুমুক্ত করতে সময় লাগে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। পরে পরিশোধিত ও জীবাণুমুক্ত বর্জ্য ২ থেকে ৩ ইঞ্চি নিচে সাধারণ বর্জ্যের ন্যায় স্যানিটারি ল্যান্ড ফিলিং করা হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে সংক্রামিত রিসাইক্লিংযোগ্য বর্জ্যও এই পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করা হয়।

মেডিকেলে ব্যবহৃত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, সংগৃহিত নমুনা বা মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ পরিশোধন করা হয় ইনসিনারেশন প্রক্রিয়ায়। এ পদ্ধতিতে দুই চেম্বার বিশিষ্ট ইনসিনারেটরের সাহায্যে ভষ্মীভূত করা হয়। ইনসিনারেটরের প্রথম চেম্বারে ৮০০ থেকে ৮৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দ্বিতীয় চেম্বারে ১১০০ থেকে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ব্যবহার করা হয়। বিদ্যুৎ ও ডিজেলের যৌথ ব্যবহারে এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এই উপায়ে ভষ্মীকরণের ফলে ডাই-অক্সিন নিঃসরণ রোধ করা সম্ভব ও প্রাপ্ত ছাই বিশেষভাবে নির্মিত কংক্রিট পিটে অপসারণ করা হয়।

মেডিকেলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, কাঁচ বা ধাতব জাতীয় রিসাইক্লিং পদার্থ জীবাণুমুক্ত করা হয় তিন চেম্বার বিশিষ্ট ট্যাঙ্কের মাধ্যমে। একমুখী নল বা বিভিন্ন আকৃতির বর্জ্যসমূহ প্রথম চেম্বারে ১৫০ থেকে ২৫০ পিপিএম ঘনত্বের ক্লোরিন পানিতে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট ধরে বিশেষ পদ্ধতিতে ডুবিয়ে রাখা হয় বর্জ্যগুলো।

দ্বিতীয় চেম্বারে ২০ থেকে ৫০ পিপিএম ঘনত্বের ক্লোরিন পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো। দ্বিতীয় চেম্বার থেকে জীবাণুমুক্ত বর্জ্যসমূহ পরিষ্কার পানিতে ধোয়ার জন্য তৃতীয় চেম্বারে স্থানান্তর করা হয়। ধৌতকৃত জীবাণুমুক্ত বর্জ্যসমূহ রোদে শুকানোর পর বর্জ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী পৃথক করে শ্লেডিং মেশিনে কেটে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। এসব টুকরা রিসাইক্লিংকারীর নিকট রিসাইক্লিং করার জন্য পাঠানো হয়।

মেডিকেলের ধারাল বর্জ্যসমূহ পরিশোধন করা হয় ডিপ বারিয়াল পদ্ধতিতে। দেহের খণ্ডিত অংশ বা অন্যান্য অতিমাত্রায় সংক্রমিত বর্জ্যসমূহ এ উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা হয়। চারদিকে সম্পূর্ণ বদ্ধ ও বিশেষভাবে নির্মিত কংক্রিটের ট্যাঙ্কে ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে অপসারণ করা হয় বর্জ্যসমূহ। অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই ধাপে বর্জ্য অপসারণের জন্য ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থাপনায় ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণ পূর্ণ হওয়ার পর চিরদিনের জন্য বায়ুরোধী করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টের আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বর্জ্যপানি কালেকশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পানি পরিশোধন প্ল্যান্টের ট্যাঙ্কে জমা হয়। যা পাম্পের সাহায্যে বর্জ্যপানি প্রাইমারি ট্যাঙ্কে নেওয়া হয় ও নির্ধারিত পরিমাণে কিছু কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্যপানি প্রয়োগ করা হয়।

এরপর কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্যপানি বায়ু ট্যাঙ্কে নেওয়া হয়। ওই ট্যাঙ্কে বায়ুপূরণ করার পর পানির উপরের অংশ সেকেন্ডারি ট্যাঙ্কে চলে যায়। এক্ষেত্রে স্লাজ অংশ ট্যাঙ্কে তলানি হিসেবে জমা হয় ও উপরের অংশ ফিল্টার মিডিয়ার মধ্যে প্রবাহিত করে পরিণত দ্রবীভূত অপদ্রব্য দূর হয়।

এ বিষয়ে প্রিজম ফাউন্ডেশন রাজশাহীর সমন্বয়কারী নাকিবুল কায়েস জানান, চলতি বছরের ৫ মাসে নগরী থেকে মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮ কেজি। এসব বর্জ্য পরিশোধিত করে রিসাইকেল উপাদান মিলেছে ৬ হাজার ৭২ কেজি। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে ৪৪ হাজার ৪৫৪ কেজি বর্জ্য থেকে রিসাইকেল উপাদান পাওয়া গেছে ১ হাজার ৩৯ কেজি।

ফেব্রুয়ারিতে ৩৬ হাজার ৬৩১ কেজি বর্জ্য থেকে রিসাইকেল উপাদান পাওয়া গেছে ১ হাজার ৯৭ কেজি। মার্চে ৪০ হাজার ২৫৭ কেজি বর্জ্য থেকে রিসাইকেল উপাদান পাওয়া গেছে ১ হাজার ৫২৩ কেজি। এপ্রিলে ৩৬ হাজার ৯৮৯ কেজি বর্জ্য থেকে রিসাইকেল উপাদান পাওয়া গেছে ১ হাজার ১৭৩ কেজি ও মে মাসে ৩৯ হাজার ৭১৭ কেজি বর্জ্য থেকে রিসাইকেল উপাদান পাওয়া গেছে ১ হাজার ২৪০ কেজি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রাজশাহীর সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, শুধু মেডিকেল বর্জ্যই রাজশাহী শহরের সমস্যা না। বাসাবাড়ি থেকে উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যগুলোও প্ল্যান্টের আওতায় আনা হয়নি। ময়লার স্তুপের মাঝে প্ল্যান্টটি করা হলেও মন্দের ভালো। আগে একেবারেই ছিল না, প্রাথমিকভাবে যে শুরু হয়েছে এটা আশার দিক। আরও গুছিয়ে এর পরিসরটা আরও বাড়ানো দরকার। একইসাথে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও শুরু করা দরকার। তাহলে নগরবাসী অনেক উপকৃত হবে।

 

 

 

আরপি/এসআর-১০



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top