রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০

ব্যস্ততা নেই চারঘাটের পাদুকাপল্লীতে


প্রকাশিত:
২৯ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৩৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৭:১৫

ছবি: প্রতিনিধি
এক গ্রামে ৭৫টি জুতা তৈরির কারখানা। তাই গ্রামটিকে পাদুকাপল্লী হিসেবেই সবাই চেনে। গ্রামের নাম কালুহাটি। এটি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার একটি গ্রাম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কাজে জড়িত। কি নারী, কি পুরুষ- সবাই এই কাজ করেন। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও জড়িত জুতা তৈরির কাজে।
 
প্রতিবছর ঈদের আগে তাঁদের কাজ এত বেশি হয় যে দম ফেলার ফুসরত থাকে না। রোজার আগে থেকেই তারা দিনরাত এক করে কাজ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউনে এবার চিত্র ভিন্ন। কালুহাটির পাদুকাপল্লীতে এখন কাজের ব্যস্ততা নেই। শ্রমিকেরাও এখন কষ্টে দিন যাপন করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
 
এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, ১৯৮০ সালে কালুহাটি পাদুকা পল্লী গড়ে তোলার প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন সুবেদার আমজাদ হোসেন। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা পুঁজি করে পথে নামেন তিনি। এরপর জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আমিরুল, বারেক, কাশেম, দেলশাদ ও আমজাদ হোসেন ভৈরব যান। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষ করে কালুহাটে ফিরে দেলশাদ ও আমজাদ হোসেন দুজনের মালিকানায় ‘মুক্তা সু’ নামে একটি কারখানা চালু করেন।
 
বর্তমানে ছোট-বড় ৭৫টি পাদুকা তৈরি করার কারখানা গড়ে উঠেছে কালুহাটিতে। নিউ মান্নান, ন্যাশনাল, ডায়মন্ড, শ্রাবণী, পায়ে পায়ে, শিশির, মেঘলা, রানা, সিয়াম, রাসেল, মডার্ন, দেশ, এমএফ, নাজ ওয়ান, রবিনসহ নানা নামের সু ফ্যাক্টরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ১০ হাজার মানুষ জুতা-স্যান্ডেল তৈরির সাথে জড়িত। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার রয়েছে নারী শ্রমিক। যারা গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, পড়ালেখার পাশাপাশি অনেক ছাত্রও এসব কারখানায় কাজ করেন। নিজের খরচ তাঁরা নিজেরাই জোগান।
 
পাদুকা শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত রোজার মাসকেই পাদুকা শিল্পের মৌসুম ধরা হয়। এই মৌসুমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকরাও বাড়তি টাকা আয় করেন। শুধুমাত্র রোজার মাসেই একেকটি কারখানায় ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জুতা-স্যান্ডেল বিক্রি হয়। আর তাই ঈদুল ফিতর কেন্দ্রিক বাজার ধরার জন্য এক মাস থেকেই প্রস্তুতি নেন পাদুকা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। 
 
রোজা শুরুর ১০-১৫ দিন আগে থেকে রাত-দিন মিলিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে এবারের মৌসুমে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা। গত ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। এতে বিভিন্ন জেলার সব জুতা-স্যান্ডেলের দোকান বন্ধ রয়েছে। এতে করে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার জুতা বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে পাদুকা কারখানাও বন্ধ পড়ে রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন পাদুকা শ্রমিকরা।
 
নাজ ওয়ান সু কারখানার সেলাইম্যান দিলরুবা বেগম জানান, সড়ক দূর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছে চার বছর আগে। স্বামী না থাকায় সংসারের সব দায়িত্ব তার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় দুই ছেলে নিয়ে সংসার চালাতে এখন কষ্ট হচ্ছে। কারও কাছ থেকে চেয়ে ত্রাণ সহায়তাও নিতে পারছেন না। অন্য কোনো কাজ না জানায় চরম কষ্টে দিন কাটছে তার পরিবারের।
 
কনিকা সু ষ্টোর কারখানার আপারম্যান আব্দুল আলীম বলেন, পাদুকা শিল্পের এমন দুর্দিন আগে কখনও দেখিনি। কাজ না থাকায় চরম অর্থকষ্টে দিন কাটছে আমাদের শ্রমিকদের। পেট তো আর ভাইরাস চিনে না। এভাবে আমরা কতদিন চলব? এই ভাইরাস আমাদের পথে বসিয়ে ছাড়বে।
 
শিশির সু স্টোরের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ব্যবসা বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছি না। কারখানায় উৎপাদন না থাকলেও লোকসান ঠিকই গুণতে হচ্ছে আমাদের। যে কাঁচামাল মজুত রেখেছিলাম সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। আমাদের সারা বছরের ব্যবসা হয় রোজার মাসে। এই রোজায় আমার কারখানা থেকে ৩০ লক্ষ টাকার জুতা-স্যান্ডেল বাজারজাত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু ভেস্তে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।
 
কালুহাটি পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, সারা বছরের লোকসান আমরা এই মাসে ব্যবসা করে পুষিয়ে নিতে পারতাম। কারণ এই রোজার মাসে একেকটি কারখানা থেকে কয়েক কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করা হতো। অথচ গতবছরের  রোযা ও এবারের রোজার মাসেই আমাদের সবচেয়ে বেশি লোকসান হচ্ছে। সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। নয়তো এ শিল্পের সাথে জড়িতরা একেবারে পথে বসে যাবে।
 
আরপি/ এসআই


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top