রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


হৃদয়ের না বলা কথা


প্রকাশিত:
৮ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৫৫

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:১৩

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে সমাজ বিজ্ঞানে মাষ্টার্স পাশ করার পর মাঝে মাঝে সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করলেও সময়াভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করা হয়নি। সম্প্রতি ঢাকায় গিয়েছিলাম ৩৫ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন পুরোটা সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে। আজিমপুরস্থ বাসা থেকে রওয়ানা হয়ে সকাল ০৯.৩০ টার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সামনে গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছাতেই মনে পড়ে যায় আমার শিক্ষক ড. নাজমুল করিম, ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, ড. রঙ্গলাল সেন, ড. আব্দুর রহমান সিদ্দীকি, প্রফেসর সাদউদ্দীন, প্রফেসর আফসার উদ্দীন, প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ, প্রফেসর মাহমুদা বেগম, প্রফেসর সৈয়দ আলী নকি, প্রফেসর সরদার ফজলুল করিম সহ আরও অনেক স্যারের কথা। তাদের স্মরণ করে মনটা ভারী হয়ে চোখের পাতা ক্রমশই ভিজে যাচ্ছিলো। হারিয়ে যাচ্ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব পুরনো দিনে।


তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনকার মতো জমজমাট অবস্থা ছিল না। ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ হাজারের মতো। এখন এর সংখ্যা ৩৩ হাজার। মোবাইল, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি না থাকায় বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাতেই ছিল আলোচনার মাধ্যম। এখন বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন বিভাগ চালু হলেও তখন এতো ছিল না। আমি সলিমুল্লাহ (এস.এম) হলে সংযুক্ত থাকলেও বেশির ভাগ সময় অবস্থান করতাম স্যার এ.এফ. রহমান, মহসিন ও সূর্যসেন হলে। হলে থাকার মজাই আলাদা। পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে গল্পগুজবের মাধ্যমে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, চা ভাগাভাগি করে খাওয়া, কোন বন্ধুর সাথে কোন বান্ধবীর প্রেম, প্রেমে সফলতা অথবা ব্যর্থতা ইত্যাদি কত ধরণের যে আলাপ হতো তা বলে শেষ করা যাবে না। সূর্যসেন হলে আমাদের এক বন্ধু সব সময় গাই তো, ‘.... এই করেছো ভাল নিঠুর হে, এই করেছোা ভাল....’। কিংবা ‘..... আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান......’। অথবা ‘......... ভাল আছি ভাল থেকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ .....’। দীর্ঘ ৪ বছর প্রেম করার পর তার প্রেমিকা তাকে ফেলে আরেকটি ছেলেকে বিয়ে করার পর থেকেই সে সবসময় এ গানগুলি গেয়ে মনের ব্যাথা লাঘব করার চেষ্টা করতো। মাঝে মাঝে সে গভীর রাতে ছাদে বসে একা একা ঐ গানগুলো গাইতো। তাকে নিয়ে হলে অনেকেই হাসাহাসি করলেও বেশির ভাগই তাকে সমবেদনা জানাতো।


এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু মির্জা আহাদের সঙ্গে দেখা। সে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করতো। আমাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমার পানে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ বলে বসে, মির্জা না? প্রথমে আমি তাকে চিনতে না পারলেও পরবর্তীতে চিনতে পেরে আরে মির্জা আহাদ বলে আনন্দের বাধ ভেঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। ৩৫ বছর পর তার সাথে দেখা। কাকতালীয়ভাবে সেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মতো ঘুরতে এসেছে। মির্জা আহাদ অনেক মোটা হয়ে গেছে। চেহারায় বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট। তাই তাকে প্রথমে চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমাকে সে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করতেই থাকে-কি করছিস, কয় ছেলে-মেয়ে, তারা কি করে, তোর শরীর কেমন, কোথায় সেটেল্ড হয়েছিস, ভাই-বোনেরা কোথায়? ভাবী কেমন আছে ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। তাকে থামিয়ে বলি, চল আগে মধুর ক্যান্টিনে বসি। চা খেতে খেতে ধীরে সুস্থে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তোর সম্পর্কে জানবো।
দু’জনাই মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে চা সিংগাড়া খেতে খেতে চাকুরী ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় মেতে উঠি। আমার একমাত্র মেয়ে ডাক্তার ও তার হাসবেন্ড পুলিশ সুপার এবং ছেলে ডাক্তারী পড়ছে জেনে সে খুশী হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে আহাদ বলে, মির্জা মধুর ক্যান্টিনের বাম পার্শ্বের এই জায়গাটা তো তোর খুব প্রিয় ছিল। এ জায়গা ছাড়া তোকে অন্য জায়গায় খুব কম বসতে দেখেছি। তার কথায় ফেলে আসা সেই সোনালী দিনগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাই। স্মৃতিপটে ভেসে আসে মধুর ক্যান্টিনের স্মৃতিমাখা মধুর সেই দিনগুলো। কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে জানায়, একদিন মধুর ক্যান্টিনে চা খাওয়ার সময় চায়ে চিনি না দেওয়ায় তোর সে কি রাগ। রাগে তুই চা ফেলে দিয়েছিলি। পরপর দু কাপ চিনি মেশানো চা খাইয়ে তোকে শান্ত করা হয়। কি মনে আছে সেই কথা। কিরে কোথায় ডুবে গেছিস? সম্বিত ফিরে বলি কই না তো?


মির্জা আহাদ রসিকতা করে বলে, রোজী নামে একটি সুন্দরী মেয়ে তোকে একদিন মধুর ক্যান্টিনে চা খেতে ডেকেছিলো। কিন্তু তুই ভয়ে যাসনি। পরবর্তীতে এটা নিয়ে ক্লাশে প্রায়ই হাসাহাসি হতো। কি ঐ কথা তোর মনে আছে? আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে জানাই, আছে দোস্ত। আচ্ছা রোজীর ডাকে তুই সাড়া দিসনি কেন বলতো? উত্তরে আমি বলি- জানিস, মেয়েটি এর আগেও নাকি চার জনের সঙ্গে প্রেম করেছে। একটি ছেড়ে আরেকটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। এ কথা জানার পর ভয়ে তার সাথে আমি সম্পর্ক গড়িনি। ভয়ছিলো সম্পর্ক গড়ার পর আমাকে ছেড়ে যদি সে আরেকটি ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এতে তার কিছু হবে না। কারণ এটি তার অভ্যেস। কিন্তু আমার অবস্থাটা কি হতো তা একবার ভেবে দেখেছিস? ছ্যাক খাওয়া ছেলেগুলোর মতো গেয়ে বেড়াতে হতো, ‘প্রেমের নাম বেদনা, সে কথা বুঝিনি আগে.....’। কিংবা ‘..... তুমি আজ কত দূরে ....’ অথবা ‘.... আজ দু’জনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে .....’, তাই যাইনি। এ সময় খোরশেদ বলে ওঠে, জানিস রোজী আমাকে প্রস্তাব দিলে আমি অবশ্যই তার সাথে সম্পর্ক গড়ে চুটিয়ে প্রেম করতাম। কারণ ক্লাশে সে ছিল সেরা সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়া। পরে চলে গেলে যেতো। আফসোস সে আমাকে চিনতে পারে নাই।
মধুর ক্যান্টিনে আমাদের আড্ডা যখন বেশ জমে উঠেছে তখন হঠাৎ একজন শশ্রুমন্ডিত ধপধপে সাদা চুল ও দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি এসে আমাদেরকে দেখে সামনে এসে মির্জা সারোয়ার, মির্জা আহাদ না? আমরা হতচকিত হয়ে উঠি কিন্তু তাকে চিনতে পারিনা। সে দরাজ গলায় বসন্ত হাওয়ার মতো উদাস হয়ে হা হা করে হেসে বলে, আরে আমি তোদের ক্লাশমেট শিহাব। অবশেষে দু’জনাই তাকে চিনতে পেরে আনন্দে অশ্রু সিক্ত হয়ে যাই। কিন্তু একি তার অবস্থা। দেখে মনে হচ্ছে যেন ৯০ বছরের বৃদ্ধ। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সে ছিল তরতাজা প্রাণবন্ত এক যুবক যাকে দেখলেই মেয়েরা প্রেমে পড়ে যেত। কথা প্রসঙ্গে সে জানায়, একটি সরকারী ব্যাংকে উচ্চপদে চাকুরী করার পর সম্প্রতি সে অবসরে গেছে। এতদিন সময় না পেলেও এবার ঢাকায় এসে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে এসেছে। আর কি সৌভাগ্য প্রথম দিন এসেই দুই মির্জার সঙ্গে দেখা। আলাপের এক পর্যায়ে শিহাব জানায় যেহেতু মির্জা আহাদ বয়সে আমার চেয়ে এক বছর বড় সেহেতু ক্লাশে তাকে বড় মির্জা আর আমাকে ছোট মির্জা বলে ডাকা হতো। কি তোদের মনে আছে? দু’জনাই জানাই, এ কথা কি ভোলা যায়। শিহাব চেয়ার টেনে আমাদের সাথে বসে পড়ে। এ সময় একটি মেয়ে শিহাবের কাছে এসে বলে, হুজুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। আমার জন্য দোওয়া করবেন। শিহাব মেয়েটিকে দোওয়া করে। চেহারা দেখে মেয়েটি ভেবেছে শিহাব হয়তো কোন বুজুর্গ আলেম ব্যক্তি। মেয়েটি চলে যেতেই আমরা সবাই একযোগে হেসে উঠি। কারণ শিহাব ঈদের নামাজ ছাড়া এক ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে কি না সন্দেহ।


পুনরায় চা সিংগাড়া খেতে খেতে শিহাবকে জিজ্ঞেস করি- রিয়া নামে যে মেয়েটিকে তুই ভালবাসতিস, তার সঙ্গে কি তোর বিয়ে হয়েছিলো? শিহাব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনেকক্ষণ নিরব থেকে মুখে এক টুকরো কষ্টের হাসি হেসে বলে, বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু? কিন্তু কি জানতে চাওয়ার সে বলে দু’বছর সংসার করার পর এক বছরের মেয়ে সন্তান রেখে সে আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়ে আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কি আর বিয়ে করিসনি? উত্তরে শিহাব জানায়, মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করা হয়নি। মেয়েটি এখন কোথায়, কি করছে? মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় শিহাব হু হু করে কেঁদে ওঠে বলে, আমার সব স্বপ্ন দ্বিতীয় বারের মতো হারিয়ে গেছে রে। মেয়েটি ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে ব্যারিষ্টারী পাশ করে আর ফিরে আসেনি। শুনেছি, সেখানে সে তার মায়ের সাথে বসবাস করছে। প্রথম প্রথম যোগাযোগ রাখলেও দু’বছর হলো সে আর যোগাযোগ করে না। শিহারের ব্যথাতুর চোখে পানি দেখে আমাদের চোখের পাতাও ভিজে যায়। যেন তার জীবনে রংধনুর রং মুছে গেছে। সবসময় শিহাবের চোখে মেয়ের শত স্মৃতি ভেসে আসে। বর্তমানে জীর্ণশীর্ণ ঝরা পাতার মতো তার জীবনটা কোন রকমে কেটে যাচ্ছে।
পরিবেশ হালকা করার জন্য বলি, চল সবাই টি.এস.সি-তে যাই। অনেকদিন পর সেখানে বসে চুটিয়ে আড্ডা মারবো। হারিয়ে যাবো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জীবনে। তিনজন মিলে হেঁটে হেঁটে টিএসসিতে পৌঁছে সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। এক জায়গায় বসে সবাই স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অনেকটা সময় এখানেই কেটেছে। এখানে বসে বাদাম খেতে খেতে কত যে আড্ডা মেরেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। অডিটরিয়ামের ভিতর প্রবেশ করতেই হঠাৎ শিহাব কেঁদে ফেলে। কিরে কাঁদছিস কেন? সে আফসোস করে বলে, জানিস একটি অনুষ্ঠান চলাকালে তোর ভাবীর সাথে এখানেই আমার পরিচয়, পরিচয় থেকে ভালবাসা। ভালবাসা থেকে বিয়ে। অবশেষে বিয়ের পর সন্তান রেখে পালিয়ে যাওয়া। শিহাব জানায়, ক্লাশের আগে, ক্লাশ শেষে কিংবা বন্ধের দিন তোর ভাবীর সাথে এখানে আড্ডা মেরে চুটিয়ে প্রেম করতাম। সেই-ই প্রথমে প্রপোজ করে। অথচ সে আমায় ছেড়ে চলে গেল। শিহাব হাত দিয়ে বারবার চোখের পানি মুছে। জানায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেকটা দিন তারা এখানেই একসঙ্গে কাটিয়েছে। চা ভাগাভাগি করে খেয়েছে। চিনাবাদাম কিনে দুজনাই দুজনকে খোসা ছাড়িয়ে দিয়েছে। একই আইসক্রীম দুজনেই খেয়েছে। মাঝে মাঝে বিরিয়ানি কিনে একে অপরকে খাইয়েছে। এ ধরণের কত মধুর এবং স্বপ্নীল স্মৃতির কথা শিহাবের স্মৃতিপটে ভেসে আসে। স্বত:স্ফূর্ত আবেগ ও উৎসাহ নিয়ে শিহাব ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে করতে একসময় নিরব হয়ে যায়। তার জন্য খুবই দুঃখ হয়। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে এখন সে একা। হোটেলে খায় এবং রাত্রিতে বাসায় গিয়ে শুইয়ে থাকে। এ সময় পরিবেশ হালকা করার জন্য মির্জা আহাদ হঠাৎ গেয়ে উঠে, ‘ভালবেসে গেলাম শুধু, ভালবাসা পেলাম না, আশায় আশায় দিন যে গেল.........’ ‘..... আমার জীবনের এত হাসি এত খুশি আজ কোথায় গেল.....’। ‘..... বন্ধু তিন দিন তোর বাড়ীত গেলাম দেখা পাইলাম না....’। শিহাব সহ আমরা সবাই হেসে উঠি। শিহাবকে টিএসসি থেকে সরানোর জন্য লাইব্রেরী উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।


লাইব্রেরীতে প্রবেশ করতেই মির্জা আহাদ হঠাৎ দ্রুত গতিতে একপাশে গিয়ে বসে পড়ে। আমরা তার কাছে গিয়ে দেখি সে উদাস হয়ে আনমনে কি যেন ভেবেই চলেছে। আমরা তার কাছে যাবার পরও সে টের পায় না। তাকে হালকা ধাক্কা মারতেই তার সম্বিত ফিরে আসে। কি ব্যাপার মির্জা আহাদ তুই কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? সে চোখ ছল ছল করে বলে, তোরা তো জানিস রাখী নামে জুনিয়র ক্লাশের একটি মেয়ের সাথে দীর্ঘ ৫ বছর সম্পর্ক থাকায় পরও সে আরেকটি ছেলেকে বিয়ে করে। দু’জনাই এখানে বসে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রেম করতাম। প্রেমের পাশাপাশি বই পড়ে দুজনা মিলে কত যে নোট করেছিলাম তা বলে বোঝাতে পারবো না। এখন রেখার অবস্থা কি? অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর মির্জা আহাদ বলে, বিয়ের পর জানতে পারে তার স্বামী বিবাহিত এবং মাদকাসক্ত। আগের পক্ষের এক ছেলে রয়েছে। এ কথা জানার পর সে তার স্বামীকে ছেড়ে চলে আসে। আমার সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমি সাড়া না দেওয়ায় আর এগোয়নি। হঠাৎ শুনি স্বামীকে ছেড়ে আসার ২ মাসের মাথায় সে বিষপানে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এর পরে রেখা নামে একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পারিবারিকভাবে বিয়ের কথাবার্তা চলার সময় সেও আরেকজনের সঙ্গে পালিয়ে যায়। পরপর দুটো ঘটনার জন্য আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। দুঃখের বোঝা কাঁধে নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে চলেছি। দু’জনার বেদনাদায়ক ঘটনার কথা শুনে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দুরে তখন একটি গান বাজছিলো- ‘এ তো হাসি আর গান যদি কোন দিন থেমে যায়....। আসলেও তাই মির্জা আহাদ আর শিহাবের জীবনটা চলার পথে হঠাৎ যেন থেমে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুধায় আমরা কাতর হয়ে পড়ি।


দুপুরে ডাকসুর ক্যান্টিনে একসঙ্গে ৩ জন খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বসে অনেকক্ষণ জমজমাট আড্ডা মারি। তিনজন মিলে স্মৃতি রোমন্থনে বারবার পুরনো দিনগুলো সামনে এনে কথা বলেই যাচ্ছিলাম। এ যেন এক আবেগময় মূহুর্ত। কেউ কথা ছাড়তেই চায়না, বলতেই থাকে। কথা বলে যেন সবাই হালকা হতে চাইছিলো। অনেকক্ষণ বলার পর তিনজনে প্রথমে সলিমুল্লাহ, এরপরে মহসিন হল এবং সবশেষে সূর্যসেন হলে যাই। উল্লেখ্য যে, আমি ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ, মির্জা আহাদ মহসিন এবং শিহাব সূর্যসেন হলে থাকতাম।
বর্ণিত হলগুলোতে আড্ডা মেরে সেখান থেকে পুনরায় আমরা টিএসসিতে গিয়ে গল্পে গল্পে অতীতের সেই সোনালী দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম। অবশেষে রাত ৮ টার সময় ক্লান্ত পাখীর মতো যার যার গন্তব্য স্থলে রওয়ানা হই। যাবার আগে আমরা প্রত্যেকে জড়িয়ে ধরে অগোচরে চোখের পানি ফেলছিলাম বেদনায় দিশেহাারা হয়ে মনে প্রচণ্ড হতাশা আর বিষন্নতা এনে। এ জীবনে হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে। ফিরে আসার সময় প্রত্যেকের চেহারায় ছিল বিষাদের স্বাদ এবং আবার দেখা হওয়ার ক্ষিণ অথচ তীব্র আকাংখা। যার মাধ্যমে আমরা সবাই পাবো বেঁচে থাকার অফুরন্ত অনুপ্রেরণা। ক্লান্ত করুন চোখে চুপ চাপ ভগ্ন হৃদয়ে আমরা ফিরে চলি রাস্তায় থাকা ঘন কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে। প্রত্যেকের চোখে ছিল বিদায়ের শেষ অশ্রু। দূর থেকে তখন একটি গান ভেসে আসছিলো, ‘..... ছেড়ে যেতে হবে সব, জীবনের এই কলরব ....।’


লেখক: সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তা 

আরপি/ এআর

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top