রাজশাহী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


লাশের ডাম্পিং জোন বুড়িগঙ্গা, ১১ মাসে ৩২৫টি লাশ উদ্ধার


প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২২ ১৯:০৪

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৩৩

ছবি: প্রতিকী

দেশে নদ-নদী ও সাগর থেকে গত ১১ মাসে ৩২৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯ জনকে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের জালে উঠে আসছে মৃতদেহের কঙ্কাল-খুলি।

জামালপুরের মাদারগঞ্জে যমুনা নদী থেকে ব্যাগভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম ইপিজেড থানা এলাকা থেকে অপহৃত শিশু আয়াতকে শ্বাসরোধে হত্যার পর মরদেহ ছয় টুকরা করে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।

পুলিশ বলছে, হত্যার পর নদীতে কেন লাশ ফেলা হচ্ছে দীর্ঘ তদন্তে তার কারণ বেরিয়ে এসেছে। নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার পর দ্রুত তাতে পচন ধরে। ফলে উদ্ধারের আগেই লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে আলামতও নষ্ট হয়ে যায়। এতে আর লাশ শনাক্ত করা যায় না। নিজেদের আড়াল করতেই হত্যাকারীরা নদীতে লাশ ফেলে দেয়।

এদিকে হত্যার পর লাশ গুমের নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছে রাজধানীর চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বংশী, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী। মাঝেমধ্যেই এসব নদী থেকে পচা গলিত লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। গত ১১ মাসে শুধু বুড়িগঙ্গা নদী থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে ৪১টি লাশ। এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন স্থানে হত্যার পর লাশ ফেলা হচ্ছে নদীর নির্জন স্থানে। পরেউদ্ধার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পচা-গলা লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ সময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। কিছু লাশ চিহ্নিত হলেও তথ্য-প্রমাণের অভাবে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা যায় না।

যা আছে নৌ পুলিশের পরিসংখ্যানে : নৌ পুলিশের তথ্য বলছে, নদীতে ফেলে যাওয়া লাশের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ৩২৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি নভেম্বরে নদী থেকে সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে চলতি বছর উদ্ধার করা ৪৯টি লাশের ক্ষেত্রে তদন্তে জানা গেছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে। ১৬২টি লাশের হত্যার সঠিক কারণ জানা যায়নি। এসব ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা করে তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্ত ছাড়া ১১৫টি লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনাক্ত করা গেছে ২৯টি লাশ। ৯২টি লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অন্যদিকে গত ২১ মাসে দেশের নদীগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৬৭৯টি লাশ।

২০২১ সালে নদী থেকে উদ্ধার করা ৩৫৭টি লাশের মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৩৬টি, ময়নাতদন্ত ছাড়া পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ১৯৮টি লাশ। শনাক্ত করা গেছে ২৬৯টি আর শনাক্ত করা যায়নি ৮৮টি লাশ।

এসব লাশের বেশির ভাগের পরিচয় না পাওয়া, হত্যা না দুর্ঘটনা তা নিশ্চিত হওয়া নিয়ে বিপাকে তদন্তকারী সংস্থা। কিছু লাশের ক্ষেত্রে শরীরে আঘাতের চিহ্ন পেয়ে পুলিশ হত্যা মামলা করেছে। যেসব লাশের শরীরে হত্যার আলামত পাওয়া যায় না সেগুলোর ক্ষেত্রে অপমৃত্যুর মামলা হয়। আর বেশির ভাগ পরিচয়হীন লাশ দাফনের জন্য দিয়ে দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির রহস্য উদঘাটন করতে পারলেও মামলা বছরের পর বছর তদন্তের বেড়াজালে আটকে আছে।

লাশের ডাম্পিং জোন বুড়িগঙ্গা : বুড়িগঙ্গা নদী থেকে লাশ উদ্ধারের বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীটি এখন লাশের ‘ডাম্পিং জোন’ হিসেবে পরিচিত। নিখোঁজের পাঁচ দিন পর গত ১২ নভেম্বর কেরানীগঞ্জের উত্তর পানগাঁওয়ের বুড়িগঙ্গা নদী থেকে নৌ পুলিশ উদ্ধার করে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লবের লাশ। তাঁর লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মফিজউদ্দিন প্রধান নিপুণ জানিয়েছেন, দুরন্ত বিপ্লবের মাথায় ও বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে পিবিআই বলেছে, নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে সাঁতার না জানায় বিপ্লব মারা যান। এ ঘটনায় তদন্ত অব্যাহত আছে।

এর আগে গত ৭ নভেম্বর বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের লাশ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। পরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক জানান, ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাঁকে কে বা কারা হত্যা করেছে সে রহস্য এখনো জানা যায়নি। শুরু থেকে এই শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয় একই নদী থেকে।

শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধারের দুই দিন পর কাছাকাছি এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করা আরেক যুবকের লাশের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। এর দুই মাস আগে এসব নদী থেকে আরো আটটি লাশ উদ্ধার করা হয়।

গত ৯ জুলাই অপহরণ করা হয় স্কুলছাত্র ইমনকে। পরে তাকে হত্যার পর লাশ ফেলা হয় গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার রসুলপুর এলাকার ধলেশ্বরী নদীতে। এর সাত দিন পর রাজধানীর গাবতলীর আমিনবাজার এলাকার তুরাগ নদ থেকে উদ্ধার করা হয় তার গলিত লাশ।

এ ছাড়া গত ১১ মাসে তুরাগ নদ থেকে ১৪টি, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ২০টি এবং অন্য নদীগুলো থেকে আরো ২৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার।

চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ঢাকার ফরিদাবাদ আর্সিন গেট এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর (২০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হয়, তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত ১২ অক্টোবর বরিশালের আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে হাতে-পায়ে ইট বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় (৩৫) এক ব্যক্তির লাশ। গত ৩ নভেম্বর শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মা নদী থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় আকিনুর আক্তার (৩৪) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

বালু নদে ভাসছিল অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের মরদেহ : গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থানার কায়েতপাড়া এলাকায় বালু নদ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় (৩৫) এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। ওই দিন রাত ১০টার দিকে নৌ পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে খিলগাঁও থানা পুলিশকে খবর দেয়। পরে খিলগাঁও থানার পুলিশ লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

খিলগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আসাদুজ্জামান জানান, নৌ পুলিশের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, কায়েতপাড়া বাজার এলাকায় বালু নদে লাশটি ভাসছিল। লাশের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

নদী থেকে লাশ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নৌপথে কিংবা নদী থেকে উদ্ধার করা প্রতিটি লাশের তদন্ত করা হয়। তবে বেশির ভাগ লাশে পচন ধরায় শনাক্ত করা যায় না। এতে তদন্তে বাধা তৈরি হয়। লাশের পরিচয় জানা গেলে হত্যারহস্য উদঘাটন সহজ হয়। অপরাধীরাও ধরা পড়ে। ’

জানতে চাইলে এ বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান লিটন বলেন, ‘দেশে যখন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করে, তখন খুনখারাবি বেড়ে যায়। নদী থেকে পর পর বুয়েট শিক্ষার্থীসহ ১১ মাসে এই যে এতগুলো লাশ উদ্ধার হয়েছে, এতে উদ্বেগের কারণ আছে। এসব ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। অপরাধীরা গ্রেপ্তার না হলে এ প্রবণতা বাড়তে থাকবে। নৌপথে মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে দেখতে হবে। এভাবে লাশ উদ্ধার হতে থাকলে মানুষ নৌপথে চলাচল করতে চাইবে না। তার চেয়ে বড় কথা, দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইন-শৃৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top