রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


একটু ভুলের জন্য


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০১৯ ১২:২৯

আপডেট:
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:৪৫

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম:

মৌসুমী একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিষয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সুন্দরী এবং শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে বলে খুবই অহংকারী। ক্লাশে দু’একজন ছাড়া কারো সাথে কথাই বলেনা। সকালে দামী গাড়ী হাকিয়ে ক্লাশে আসে। মা আরেকটি গাড়ীতে দুপুরে বাসা থেকে খাবার পাঠালে মৌসুমী ক্যান্টিনে বসে তা খায়। একেক দিন একেক ধরনের জামা পরে আসে। পোশাক-পরিচ্ছদ এবং মেজাজে উগ্র। সবসময় রেগেই থাকে। কেউ কথা বলতে চাইলে সে কথা না বলে এড়িয়ে চলে। প্রয়োজন না হলে কেউ তার সাথে কথা বলতেও চায়না। কয়েকটি ওভার স্মার্ট ছেলে তার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য কয়েকদিন পিছনে ঘুর ঘুর করেও পাত্তা না পেয়ে হাল ছেড়ে দেয়।


মাসুম নামে ঐ ক্লাশের একটি ছাত্র ছিল খুবই গরীব। সে এতো গরীব যে, মাঝে মাঝে ক্লাশে না খেয়ে একই জামা পরে আসতো। থাকতো কমলাপুর রেল ষ্টেশন সংলগ্ন বস্তিতে। সামনে যারা বসতো তারা সবাই ধনী পরিবারের ছেলে। তাদের গায়ের জামা কাপড় অন্তত দামী এবং রুচিশীল। এ কারণে মাসুম শেষ বেঞ্চিতেই বসতো। সে এতো নিরীহ প্রকৃতির যে ভুল করেও কোন মেয়ের দিকে তাকাতো না।


মৌসুমীর আচরণে কিছু ছেলে ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলার জন্য সবার অগোচরে তার ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে লিপিষ্টিক, ছোট আয়না, চিরুনী এবং ফেস পাউডার সরিয়ে মাসুমের ব্যাগে লুকিয়ে রাখে। অবসর সময়ে মেকআপ নেওয়ার জন্য মৌসুমী তার ব্যাগ খুলে উপরোক্ত জিনিসগুলো না পাওয়ায় ক্লাশে হৈচৈ বাঁধিয়ে দেয়। সে এ ব্যাপারে টিচারের কাছে অভিযোগ জানানোর কথা বলায়, বাধ্য হয়ে সবার ব্যাগ তল্লাশী করে মাসুমের ব্যাগ থেকে তা উদ্ধার করা হয়। মৌসুমী তার হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো মাসুমের ব্যাগে পেয়ে প্রচন্ড রেগে তার বিরুদ্ধে স্যারের কাছে চুরির অভিযোগ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় মাসুম হতভম্ব হয়ে ভাবতে থাকে, মৌসুমীর ব্যক্তিগত জিনিসগুলি কিভাবে তার ব্যাগে এলো ? সে মৌসুমীকে বিনয়ের সাথে জানায় যে, এগুলি সে চুরি করে নাই। কেউ হয়তো দুষ্টুমী করে তার ব্যাগে রেখেছে। কিন্তু মৌসুমীকে কিছুতেই বোঝানো যায়না। বরং সে তাকে যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করে। এক পর্যায়ে সে মোবাইলে তার শিল্পপতি বাবাকে ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানায়। ক্লাশের সবাই মাসুমকে অপমান করে বলে, দেখে মনে হয় ভিজা বিড়াল। কিন্তু তলে তলে এতো শয়তানী তা তাদের জানা ছিল না। স্যার ক্লাশে এসে মাসুমকে তার কৃত অপরাধের জন্য ক্লাশ থেকে বের করে দেয়। লজ্জায় অপমানে মাসুম কেঁদে ফেলে ঘটনার জন্য সে কোন ভাবে দায়ী নয় বলে স্যারকে জানায়। কিন্তু স্যার কোনভাবেই তার কথা বিশ্বাস করে না। অগত্যা মাসুম মাথানত করে লজ্জাবনত দৃষ্টিতে ক্লাশ থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে মৌসুমির দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকায়।

মাসুম একমাস যাবত ক্লাশে না আসায় যারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছিল তারা বিবেকের তাড়নায় মৌসুমীকে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। এ দিকে ক্লাশ পরীক্ষার ফল বের হলে দেখা যায় যে, মাসুম প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এর আগে কেউ এতো নম্বর পায়নি। স্যার এমনকি কর্তৃপক্ষ তার খোঁজ করতে থাকে। ঘটনা জানার পর মৌসুমী রেজিষ্টার অফিস থেকে তার ঠিকানা সংগ্রহ করে কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে কমলাপুর বস্তিতে গিয়ে জানতে পারে যে, মাসুম এক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসার পথে অন্য মনস্ক থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। এ সময় তার ব্যাগের ভিতর একটি চিঠি পাওয়া যায়। চিঠিটি বস্তির একজন মাসুমের ঘর থেকে এনে মৌসুমীর হাতে দেয়। যাতে লেখা ছিল, মৌসুমী ম্যাডাম, সুন্দর বলে আমি আপনাকে পছন্দের সাথে সাথে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতাম। কেন জানি আপনাকে খুবই ভালো লাগতো। মাঝে মাঝে আপনাকে আঁড় চোখে দেখে ভাবতাম মানুষ কিভাবে এতো সুন্দর হয়? বিধাতা মনে হয় আপনাকে নিজের হাতে বানিয়েছেন। কিন্তু আপনার সাথে কথা বলার সাহস হতো না। কারন আপনি তো ধনীর ঘরের মেয়ে। আমি গরীব দিনমজুরের ছেলে। কমলাপুর বস্তিতে ২০০ টাকায় এক খুুপড়ি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। খেয়ে না খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হেঁটে যাতায়াত করতাম। আপনাকে পছন্দ করলেও মুখ ফুটে বলতে পারিনি। কারন আমাদের মতো গরীবের কাছে এটা আকাশ কুসুম। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো। আর আপনি যে ধরনের রাগি, ভয়ে কখনো কথা বলার সাহস পাইনি। এখন বলুন, ভাল লাগার এবং পছন্দের মানুষের ব্যাগ থেকে কোন জিনিস কি সরানো যায়?

আপনি বকাঝকা করে অপমান করলেও আমি রাগ করিনি। কারন এ ঘটনার জন্য আমি দায়ী ছিলাম না। তবে আপনার রাগান্বিত চেহারা আমার খুব ভাল লেগেছিল। রাগলে আপনাকে কতটা সুন্দর দেখায় তা আপনি নিজেও হয়তো জানেন না। ক্লাশ থেকে বের হয়ে লাইব্রেরীতে বসে আপনাকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠি লিখলাম। ভাবছি কয়েকদিনের মধ্যে এটি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে ভুল ভাঙ্গিয়ে তবে ক্লাশে যাবো। বিধাতার কাছে দোওয়া করি আপনি আরো সুন্দর এবং ভুল না বুঝে আমার প্রতি সদয় হন। ইতি- বস্তিবাসী মাসুম।

মাসুমের চিঠি পড়ে মৌসুমী কেঁদে ফেলে। সাথে সাথে সহপাঠিরাও তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। মৌসুমী ভাবে, তার ভূলের জন্য কতো বড় হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে যা ক্ষমার অযোগ্য। সে বারবার মাসুমের চিঠি পড়ে কেঁদেই চলে। এ কান্না থামার নয়। মৌসুমীর এ কান্নার অবসান হবে কি?

লেখক: সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top